রহস্যে ভরা কৃষ্ণ গহ্বর

রহস্যে ভরা কৃষ্ণ গহ্বর

ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের কথা আমরা সবাই শুনেছি। কিছুদিন আগে M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি খবরের কাগজ থেকে সামাজিক মাধ্যম, সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া কৃষ্ণ গহ্বরদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক শ্রেণির ভর হল সূর্যের ভরের একশো গুণের মধ্যে, এরা হল মৃত নক্ষত্রের অবশেষ। দ্বিতীয় শ্রেণিকে বলা হয় অতি ভারী, তাদের অবস্থান ছায়াপথের কেন্দ্রে, ভর সাধারণভাবে সূর্যের ভরের কয়েকলক্ষ গুণ থেকে কয়েকহাজার কোটি গুণ পর্যন্ত হতে পারে। কীভাবে তারা তৈরি হয়েছে সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নন। আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বর আবিষ্কারের জন্য ২০২০ সালে রাইনহার্ড গেঞ্জেল ও আন্দ্রিয়া ঘেজ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
কৃষ্ণ গহ্বরের ব্যাস মাপা গেলে আইনস্টাইনের সমীকরণ থেকে তার ভর জানা সম্ভব। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরকে দেখা কঠিন। একমাত্র M87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বরের ছবি থেকে তার ভর নির্ণয় সম্ভব হয়েছে, তার ভর সূর্যের ভরের ছশো পঞ্চাশ কোটি গুণ। ছবি তোলার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ যার বিভিন্ন অংশ সারা পৃথিবী জুড়ে বসানো আছে। এছাড়া যদি কৃষ্ণ গহ্বরকে কোনো নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করে, তাহলে প্রদক্ষিণকাল ও তাদের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করা সম্ভব হলে নিউটনের সূত্র থেকে ভর নির্ণয় করা যায়। গেঞ্জেল ও ঘেজ আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বরের ভর মেপে পেয়েছেন সূর্যের ভরের একচল্লিশ লক্ষ গুণ। কিন্তু তার জন্য তাঁদের গেঞ্জেল ও ঘেজকে বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্টের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলিন বুর্কে ও তাঁর সহকর্মীরা অতিভারি কৃষ্ণ গহ্বরদের ভর নির্ণয়ের এক নতুন পদ্ধতির প্রস্তাব করেছেন। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কৃষ্ণ গহ্বরের কাছের উত্তপ্ত গ্যাস ও ধূলিকণা গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণের টানে যখন তার দিকে যায়, তারা একটা চাকতির মতো তৈরি করে, তাকে বলে অ্যাক্রেশন চাকতি। চাকতিটা এতই উজ্জ্বল হয় যে সে আলো বিকিরণ করে। বিকিরণের মান সময়ের সঙ্গে বাড়ে কমে, কেন তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। বার্কে ও তাঁর সহযোগীরা সুর্যের ভরের দশ হাজার গুণ থেকে একশো কোটি গুণ ভারি এমন ৬৭টি কৃষ্ণ গহ্বরের অ্যাক্রেশন চাকতির ঔজ্জ্বল্যের বাড়াকমার সময় কালের সঙ্গে তাদের ভরের এক এক সহজ সম্পর্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন যে হালকা কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে সময়কালটা হল দু এক দিনের মতো, অতি ভারীদের ক্ষেত্রে সেটা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে কয়েকশো দিন থেকে হাজার দিনের কাছাকাছি। ঔজ্জ্বল্য বাড়া কমার সময়কাল মাপা খুব সহজ, বার্কেরা সেই পর্যবেক্ষণ থেকে কৃষ্ণ গহ্বরের ভর নির্ণয়ের প্রস্তাব করেছেন। শুধু তাই নয়, শ্বেত বামন নক্ষত্রের অ্যাক্রেশন চাকতির ক্ষেত্রেও তাঁদের নির্ণীত সম্পর্ক খাটে বলে তাঁরা দেখেছেন। শ্বেত বামন নক্ষত্ররা হল অপেক্ষাকৃত হালকা নক্ষত্রের অবশেষ, তাদের ভর সূর্যের ভরের কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে এই সম্পর্কটা আরো সার্বজনীন হতে পারে। তাঁদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি যদি কার্যকর প্রমাণিত হত তাহলে অতিভারি কৃষ্ণ গহ্বরদের ভর নির্ণয় অনেক সহজ হয়ে যাবে। লেখার প্রথমেই যে দুই শ্রেণির কৃষ্ণ গহ্বরের কথা আছে, তাদের মাঝামাঝি ভরের মাত্র একটি কৃষ্ণ গহ্বরকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা গেছে। এই পদ্ধতিতে সেই ধরনের গহ্বর খোঁজার কাজটাও সহজ হয়ে যাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাই সারা আকাশের অ্যাক্রেশন চাকতিদের ঔজ্জ্বল্য পর্যবেক্ষণের কাজ শীগগিরি শুরু করবেন।