ইঁদুরের মস্তিষ্কে মানুষের স্নায়ুকোষের বিকাশ

ইঁদুরের মস্তিষ্কে মানুষের স্নায়ুকোষের বিকাশ

গবেষণাগারে মানুষের স্নায়ুকোষ বিকাশের মূল সূত্রটা হল সেই স্নায়ুকোষ কোন মাধ্যমে বিকশিত করা হচ্ছে।পূর্বে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে যেখানে মানবদেহের স্নায়ুকোষের বৃদ্ধি গবেষণাগারের নির্দিষ্ট পাত্রে করা হয়েছে।কিন্তু একটা নতুন গবেষণায় অভিনব পদ্ধতিতে ইঁদুরের মস্তিষ্কে এই কোষ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়।১২ই অক্টোবর নেচার পত্রিকার অনলাইন রিপোর্টের সূত্রে জানা যায়,ইঁদুরের মস্তিষ্কে মানুষের নিউরোনের প্রতিস্থাপিত কোষগুলো ল্যাবের পাত্রে বৃদ্ধি পাওয়া কোষের তুলনায় আরও বেশি বড়ো ও জটিল হয়ে ওঠে।সীমিত হলেও তা বেশি কার্যকরী হয়।

প্রতিস্থাপিত মানবকোষ শুধুমাত্র ইঁদুরের কোষ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে তা-ই নয়।ইঁদুরের আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে।ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান ফ্রানসিসকো ক্যাম্পাসের স্নায়ুবিজ্ঞানী আর্নল্ড ক্রিগস্টেইনের মতে,প্রতিস্থাপিত নিউরোনের একীকরণ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা।ব্রেইন অর্গানয়েড হল স্ব-একত্রিত ত্রিমাত্রিক সমষ্টি যা স্টেম সেল থেকে গঠিত। মানব মস্তিষ্কের প্রাথমিক পর্যায়ের অনুরূপ embryonic humanbrain যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং ব্যাধির চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিগত এক দশক ধরে, বিজ্ঞানীরা স্টেম সেল থেকে ক্রমবর্ধমান জটিল মস্তিষ্কের অর্গানয়েড তৈরি করছেন যা মানব মস্তিষ্কের মতো বিকশিত হয়।এই অর্গানয়েড সাধারণ মস্তিষ্কে বিকশিত নিউরোনের মতো জটিল নয়।কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ, এবং কীভাবে এটা অন্যভাবে চালিত হতে পারে তা নির্ধারণ করতে পারে ।ক্রিগস্টেইনের মতে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় হল এই মডেলগুলো সম্পূর্ণরূপে নিখুঁত না হলেও মানব মস্তিষ্কের কোষের প্রতিনিধিত্ব করে।যা অন্য প্রাণীর মস্তিষ্কের কোষ করতে পারেনা।

স্ট্যানফোর্ড স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়ুবিজ্ঞানী সার্জিউ পাস্কা এবং তাঁর সহকর্মীরা মানবদেহের সেরিব্রাল অর্গানয়েড  কোষগুলো অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে সদ্যজাত ইঁদুরের মস্তিষ্কে স্থাপন করেছিলেন।তাঁরা দেখেন যে,সেই ইঁদুরের সাথে সাথে মানুষের অর্গানয়েডগুলোর বিকাশ ঘটতে থাকে।প্রতিস্থাপনের তিন মাস পরে দেখা যায়, অর্গানয়েডগুলো তাদের প্রারম্ভিক আয়তনের প্রায় ন’গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।শেষে ইঁদুরের মস্তিষ্কের বাইরের আবরণের প্রায় এক তৃতীয়াংশ স্থান দখল করে নিয়েছে।ফলত, ইঁদুরের কোষগুলোকে একপাশে ঠেলে এটা একটা ইউনিট হিসাবে বড়ো হয়ে উঠেছে ।

ইঁদুরের মস্তিষ্ক থেকে বিশেষ সুবিধা যেমন – রক্ত ​​সরবরাহ, সুনির্দিষ্ট পুষ্টি এবং কাছাকাছি অবস্থিত কোষ থেকে উদ্দীপনা পেয়ে মানব কোষগুলোর বিকাশ ঘটেছে।যা গবেষণাগারে সাধারণভাবে বেড়ে ওঠা কোষের পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিলনা।এই পরিবেশগত সহায়তা প্রতিটা মানব নিউরোনকে গবেষণাগারে সাধারণভাবে বেড়ে ওঠা কোষের তুলনায় শুধুমাত্র ছয়গুণ বেশি বাড়তে সাহায্যে করেছে তা-ই নয়।বরং কোষগুলো আরও জটিল হয়েছে, বিস্তৃত শাখাপ্রশাখা ধারণ করেছে।এর ফলে আরও বেশি পরিমাণে এক স্নায়ুকোষের সাথে অন্য স্নায়ুকোষের সংযোগস্থল (synapse) গঠন সম্ভব হয়েছে।গবেষণার মাধ্যমে পাস্কা এবং তাঁর সহকর্মীরা আরও দেখেন যে,নিউরোনগুলো মানবদেহের অনুরূপ আচরণ করছে এবং প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছে।

বিকাশের সময়, এই নিউরোনগুলো তাদের ইঁদুরের দেহের কোষের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে এবং ইঁদুরের দেহের উদ্দীপনায় সাড়া দিয়েছে।তাছাড়াও, মানুষের কোষগুলো ইঁদুরের আচরণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে।আরও পরীক্ষানিরীক্ষায় গবেষকরা দেখিয়েছেন,নীল আলো জ্বালালে ইঁদুরেরা উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে জলের উৎসের দিকে এগিয়ে গেছে কারণ তাদের মস্তিষ্কের মানব অর্গানয়েড কোষগুলো তখন মস্তিষ্কে সেই সংকেত পাঠিয়েছে।

আচরণগত পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, যে সমস্ত ইঁদুরের মস্তিষ্কে মানুষের স্নায়ুকোষ প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে তাদের মধ্যে উচ্চমানের বুদ্ধিমত্তা বা স্মৃতিশক্তি পরিলক্ষিত হয়নি।বরং গবেষকরা কিছু ঘাটতি নিয়ে প্রথমদিকে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন যেমন- স্মৃতিশক্তি, মোটর দক্ষতার অভাব বা খিঁচুনি সংক্রান্ত বিষয়।কিন্তু ইইজি এবং এমআরআই ছাড়াও বিস্তারিত আচরণগত পরীক্ষানিরীক্ষার পরও কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অন্য একটা পরীক্ষায়, টিমোথিসিন্ড্রোম নামে এক জিনগত ব্যাধি যা মস্তিষ্কের বিকাশ প্রভাবিত করে, সেই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্নায়ুকোষ নিয়ে কাজ করা হয়েছিল।এই পরীক্ষায় দেখা গেছে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির যে স্নায়ুকোষ, ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল সেগুলোতে সাধারণ মানুষের স্নায়ুকোষের তুলনায় কম জটিল বার্তা-গ্রহণকারী ডেনড্রাইট গঠিত হয়েছে।পাস্কার ভাবনা অনু্যায়ী,রোগীর কোষ থেকে তৈরি অর্গানয়েড গুলো ভবিষ্যতে চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। কঠিন ব্যাধি গুলো সারিয়ে তুলতে সাহসী পদক্ষেপের প্রয়োজন।তার জন্য মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে পড়াশোনা করে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।