ফিরে এল ঢাকাই মসলিন

ফিরে এল ঢাকাই মসলিন

সালটা ২০১৪, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ে। নির্দেশ দিলেন যেভাবেই হোক গবেষনা করে মসলিন কাপড় আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য যা যা লাগে, গবেষনায় নিযুক্ত গবেষকদের সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টই দেয়া হবে। ব্যস… প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল, যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ তথা ফ্রুটি কার্পাস খুঁজে বের করা। আরো দরকার, মসলিনের একটি নমুনা বা স্যাম্পল। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে। কিন্তু হাতে কোনো মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোনো চিহ্নও।
ছিল শুধু সুইডিস গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’–এর মতো কিছু বই। ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে, এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এর মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল–কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু ; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। দেশের অন্য কোনো উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তাঁরা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেন।
মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি।
গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁরা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। এই মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাঁদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না। ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান।সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–উপাত্ত তাঁরা পেয়ে যান। লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তাঁরা নিশ্চিত হন, সেটিই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। স্থানীয় আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়।
তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনো তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনো এই তাঁতিরা রয়েছেন। তাঁরা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।
সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। সেখানে রাখা ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বোনা হয়। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতিমধ্যে তাঁরা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
আজ থেকে ৫০০০ বছর আগের মিশরীয় মমীর শরীরে ভারত বর্ষের মসলিনের দেখা মেলে, অর্থাৎ চার পাঁচ হাজার বছর আগেও উপমহাদেশ থেকে মসলিন কাপড় বনিকের হাত ধরে পৌছে যেতো ফারাও’দের কাছে। সেই মসলিন হারিয়ে গিয়েছিলো। সেই মসলিন আবার ফিরে এসেছে। আন্তর্জাতিকভাবে মসলিনকে এদেশীয় পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে।