জীবনদাত্রীকে চিনতে পেরে কেঁদে ফেললেন গ্রে

জীবনদাত্রীকে চিনতে পেরে কেঁদে ফেললেন গ্রে

মুখোমুখি বসে কথা বলছেন দুজন।
একজন দেড় বছর আগে মৃত্যু মুখ থেকে ফিরেছেন। অন্যজন তাঁর জীবনদাত্রী। যিনি তাঁকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফেরালেন সেই চিকিৎসকের চেহারাটা মনেই নেই রোগীর। মনে রাখার মতো অবস্থাও ছিল না।
রোগীর নাম কার্ল গ্রে। বয়স ৬০। তাঁর উল্টোদিকে যিনি বসে তিনি আমেরিকার হামার্টন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের আইসিইউ-য়ের চিকিৎসক সুসান জৈন। সুসানের তত্ত্বাবধানেই আট সপ্তাহ ছিলেন গ্রে। ওই সময়ে কী হয়েছিল তার কিছুই মনে নেই রোগীর। তাই নিজের জীবনদাত্রীকে চিনতে পারেননি। জানতে পেরে বিব্রত বোধ করতে থাকেন তিনি। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তাঁর। মনে করার চেষ্টা করেন ওই অভিশপ্ত দিনগুলির কথা। কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আর মনে আছে বাড়ি ফিরে আসার দিনটা।
গ্রে হয়তো কোনোদিনই তাঁর জীবনদাত্রী কে তা জানতে পারতেন না, যদি না সিরিন কাল নামে এক মহিলা। ওই মহিলা শুধু গ্রে-ই নয়, গ্রের মতো চারজনের সঙ্গে তাঁদের জীবনদাতা/ জীবনদাত্রীদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছেন। ওই জীবনদাতা/জীবনদাত্রীদের কেউ চিকিৎসক কেউ বা আবার নার্স। গ্রে-দের কাছে সিরিন সাক্ষাৎ দেবদূত। ভগবানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এমন একটা সময়ে গ্রের সঙ্গে তাঁর জীবনদাত্রীর সঙ্গে দেখা হল যখন অতিমারির তৃতীয় তরঙ্গ পশ্চিমের দেশগুলিতে এসে গিয়েছে। তবুও ভয় এখন অনেকটাই কম। নানা সমস্যার মধ্যে দিয়ে হলেও টিকাকরণের কাজ চলছে। এইসময়ে একবার যদি মনে করা যায় কেমন ছিল ঠিক এক দেড় বছর আগের সেই দিনগুলি? আতঙ্কে ভয়ে দিশেহারা আমাদের জীবনটাই হয়ে উঠেছে অনিশ্চিত। এরই মধ্যে আমাদেরই মতো রক্ত মাংসের একদল মানুষ, সেই ডাক্তাররা দিন রাত চোখের সামনে দেখে গেছেন লক্ষ লক্ষ মৃত্যু। যাঁরা অতিমারির প্রকোপে হাসপাতালে কাটিয়েছেন, তাঁরা ওই দিনগুলো আর ফেরত চান না। তাঁরা আর হাসপাতালে ফিরতে চান না। কিন্তু কি করবেন ডাক্তাররা? ওই হাসপাতালই যে তাঁদের কর্মক্ষেত্র!
যাঁরা ফিরে যেতে চান না হাসপাতালে, তাঁদের সঙ্গে যদি একবার দেখা হয়ে যায় সেই ডাক্তারের, যিনি কঠিন অধ্যাবসায়ে দিনরাত জেগে চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন ওই সব মৃত্যু পথযাত্রীদের।
গত বছরের ১৫ই মার্চ গ্রে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর হাসপাতাল, আইসিইউ। হাসপাতালের দিনগুলোর কিছুই মনে ছিল না গ্রে-র। যাঁর জীবনের আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তিনি কী ভাবে বেঁচে উঠলেন, গ্রে তা জানতে চাইলেন সুসানের কাছ থেকে। সুসান রোগীকে জানান, ওই সময় প্রতিটি মুহূর্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সময় হয়ে উঠেছিল অনতিক্রম্য। ১৫ মিনিট হয়ে উঠেছিল ৪০ মিনিটের সমান। ১২ শয্যার আইসিইউতে এক সময় এসে গেলেন ৩০ জন রোগী। সেই কাতর রোগীদের ভেন্টিলেশনে দেওয়ার আগে পর্যন্ত শান্ত রাখা ছিল আর একটা চ্যালেঞ্জ।
গ্রে বুঝতে পারেন, যে লড়াইটা তাঁর কাছে ছিল তার একার, চিকিৎসক সুসানের কাছে সেই লড়াইটা নিজের জন্যে ছিল না, বরং তা ছিল অপরের জন্যে। সেই ‘অপর’ কিন্তু একজন নয়, অনেকে। সুসান গ্রেকে বলেন, অতিমারি এসে বুঝিয়ে দেয় অন্তরঙ্গতা আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সুসান মনে করিয়ে দেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে। চিকৎসকদের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর থাকে না। চিকিৎসক সব সময় জানেন না, কেন একই অবস্থার কিছু রোগী বেঁচে যান এবং কয়েকজন চলে যান না ফেরার দেশে। গ্রে শোনেন। চোখের জল ফেলেন। তাঁর জীবন ফিরে এসেছে সুসানের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং পরিশ্রমেই।
গ্রে ভাবেন, এই সহজ কথাটুকু কতদিনে উপলব্ধি করব আমরা, অন্তত লেখাপড়া জানা মানুষেরা?