ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা /২

ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরবনের কথা /২

নুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচা

(এ এক আজব জগৎ। ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে থাকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার। নদীতে কুমীর, কামট। দেশীয় ভাষায় বলে বাদাবন।
সেই বাদাবনের ছবিটাই তুলে এনেছেন কৃষিবিজ্ঞানী রথীন মণ্ডল। আজ দ্বিতীয় পর্ব)

‘কোন বনেতে তরুলতা। সকল বনের চাইতে শ্যামল।।
কোন বনেতে চলতে গেলে
দলতে হয়রে কচি বাইন-দল।।
সেই আমাদের সুন্দরবন, আমাদেরই বাদাবন রে।।’

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বাংলাদেশ’ কবিতার অনুকরণে শুরু করলাম। ত্রুটি মার্জনীয়। কেন না সামগ্রিকভাবে এ তো বাংলার বন, যাতে আছে বাঙালির মন। ম্যানগ্রোভকে স্থানীয়রা বাদাবন বলে।
বাইন, এই গাছগুলো বাদাবনের অনেকখানি অংশ জুড়ে থাকে। এরা বাদাবনের প্রধান গাছগুলির অন্যতম। বাইনকে অনেকে বানই গাছ বলেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, বাইন সুন্দরবনের সর্বত্র বিরাজতে। সুন্দরবনের শুরুতে বাইন, শেষেও বাইন। সমুদ্রের মোহনা ধরে যে ‘তন্বী তমাল তালী বনরাজী নীলা’ দেখা যায়, তাই বাইন। সমুদ্রের স্থলভাগে জলের কিনারা বরাবর এরা গাছের প্রাচীর তৈরি করে। এরাই স্থল ভাগের কোস্ট-গার্ড। বাইনের শরীরে প্রচুর ফাইবার টিসু থাকে, যা তাকে শক্তপোক্ত করে। তাই প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ভেঙ্গে পড়ে না।
বাইন তিন প্রকার হয়। জাত বাইন, কালো বাইন, ও পেয়ারা বাইন। জাত বাইনের পাতা বড়ো ও চ্যাপ্টা, দেখতে মোটা গুড়ি যুক্ত আম গাছের মতো। কালো বাইনের লম্বা ও সরু পাতা, কাণ্ড প্রায় কালো, একটু লম্বা গাছ হয়। পেয়ারা বাইনের মাঝারি চ্যাপ্টা পাতা। এর কাণ্ড দেখতে অবিকল পেয়ারা গাছের মতো। সমস্ত বাইনের শ্বাসমূল থাকে। শ্বাসমূল দেখতে পেন্সিলের মতো। এরা বাইন গাছের চারদিক ঘিরে ওঠে। অসংখ্য হয়। এদের গায়ে সরু সরু ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্র দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। নোনা মাটির ভিতরে অক্সিজেন থাকে না বললেই চলে। এরাই রক্ষাকর্তা হয়ে বাতাসের অক্সিজেন নিয়ে গাছের ভেতরে ঢোকায়। মাটির ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাই বাঁচতে পারে। গাছ তাই ভাবে … তুমি কেমন করে শ্বাস নাও হে গুণী, ‘আমি অবাক, অবাক হয়ে শুনি’।
বাইনের চারাগাছের জন্ম হয় পলিযুক্ত কাদা মাটিতে। এদের বীজের অঙ্কুরোদ্গমকে ‘ক্র্যপতো -ভিভিপেরি’ বা লুকনো জরায়ুজ অঙ্কুরদ্গম বলে। মা যেমন সদ্যজাত শিশুকে কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখে, তার কচি দেহ যাতে ধুলোবালির সংস্পর্শে না আসে। বাইনও তার অঙ্কুরিত বীজকে ফলের ভিতরে লুকিয়ে রাখে। যাতে জলের অতিরিক্ত লবণ কচি দেহকে নষ্ট না করে। এখনও ওদের ‘সময় হয়নি’, লবণ নিঃসরণের পদ্ধতি জানা নেই। বর্ষার জলে লবণের পরিমাণ কমতে থাকলে, ফলের আচ্ছাদনের ভিতর থেকে অঙ্কুরিত বীজ ধীরে ধীরে মাথা তোলে, নিজেদেরকে আত্মপ্রকাশ করে। পলিযুক্ত মাটি তুলোর মতো নরম। কচি কচি চারাগাছের বেড়ে ওঠার এক আদর্শ জায়গা। সুন্দরবনের এই কাদামাটিকে লোকেরা কৌতুক করে ‘প্রেম কাদা’ বলে। একবার লাগলে আর সহজে ছাড়ে না। এ যেন ‘পিরিতির কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না। ভুলেও যেন সুন্দরবনের ‘প্রেম কাদা’ পায়ে না লাগে।
ফাগুনের শেষে, বাইনের মুকুল আসে। মুকুল দেখতে কতকটা আমের মুকুলের মতো। প্রচুর ফুল হয়। ছোট ছোট ফুল, বাসন্তী রঙের। গাছ ভরে যায়। মৌমাছির ভিড় জমে। বাইনের নিচে দাঁড়ালে নিশ্চিতভাবে মৌমাছির গুঞ্জন শোনা যাবে। বাইনের ফুল থেকে মৌমাছিরা ভালো পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। এরাই ফুলে ফুলে পরাগ মিলন ঘটায়। সঙ্গে কালো পিঁপড়ের দল। প্রচুর ফল ধরে। প্রচুর চারাগাছ হয়। তাই সুন্দরবনে যাবেন, বাইনের ছোঁয়া পাবেন না, তা কি হয়। এ তো গানের কথা নয়…’আমার যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভেজাব না’। বাইন সর্বংসহা। কম লবণে, বেশী লবণে, এমনকি অতিরিক্ত লবণেও বাঁচতে পারে। সব ঋতুতে মানিয়ে চলায় সমান পারদর্শী। আশা করা যায়, বাইন বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়নে টিকে থাকতে পারবে।
সুন্দরবনের মানুষজন সব কিছুতেই বাইনকে ব্যবহার করে। জ্বালানি, গবাদিপশুর খাদ্য, ঘরের চাল, কাঠামো, আসবাব পত্র, বাগানের বেড়া, কি নয়! বাইন ছাড়া সুন্দরবনের মানুষকে ভাবা যায় না। গানের কথায় বলা যায় …সাধের বাইন, বানাইলও মোরে সংসারী। বাইন আছে, তাই সুন্দরবন ও আছে। ভরা কোটালে বাইনের বন, জোয়ারের জল যেন কোলাকুলি করতে থাকে। এ এক নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরি করে। বাইনের গুঁড়িতে জোয়ারের বান ঠেলা দেয়, দখিনা হাওয়া খেলে যায়। ঢেউয়ের ছলাত ছলাত শব্দ। নদীতে তরঙ্গ, মনের তরঙ্গকে জাগিয়ে দেয়। প্রেমের অনুভূতি বাড়তে থাকে। এ এক অন্য অনুভূতি! মনে দোলা দেয়। বিরহী গেয়ে ওঠে …’শুনো গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি। মনেতে লুকানো ছিল, সুপ্ত যে তিয়াসা, জাগিল মধু লগনেতে, বাড়ালো পিয়াসা। শুনো গো মধুর হাওয়া, প্রেম করেছি আমি’।
(চলবে)