ক্যাটস অ্যাণ্ড ডগস

ক্যাটস অ্যাণ্ড ডগস

ওদজাকি, বেলগ্রেড থেকে ১২০ কিমি উঃপঃ, সার্বিয়া

৭ই জুন, ২০০৫

রবিবার দুপুরবেলা। ছুটির দিনটা মাঠে মারা যাবে। বাইরে এখন খুব জোরে হাওয়া বইছে। ঝড়বৃষ্টি আসন্ন। লোকজন বাড়ির মধ্যেই আছে।

ছোট ছেলেটা বিরক্ত হয়ে ছাদে উঠল। সন্ধেতে নতুন খেলনা কিনতে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা ভণ্ডুল হল। সব ওই পাজি মেঘটার জন্য। ভীষণ রাগে সে মেঘের উদ্দেশ্য হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।

রাগ কমতে না কমতেই উপর থেকে তার গায়ে কিছু একটা পড়ল। চমকে এদিক ওদিক তাকাতেই সে খেয়াল করল, জিনিসটা মাটিতে পড়ে লাফাতে শুরু করেছে। ছেলেটা ভয় পেয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে যেতেই উপর থেকে হুড়মুড় করে আরো সেরকম প্রাণী তাদের ছাদের উপর পড়তে শুরু করল। প্রচণ্ড ভয়ে ছেলেটা দুড়দাড় করে ছাদ থেকে দৌড়ে পালাল।

বাড়ির ছাদ তখন ব্যাঙে ছেয়ে গেছে।

—————–

“মুষলধারে বৃষ্টিকে ইংরাজিতে কি বলে?”

“Torrential rainfall.”

“ওটা তো আছেই। তাছাড়াও আরেকটা কি যেন বলে না?”

“ও, বুঝেছি। Raining cats and dogs তো?”

“ঠিক ঠিক। ওটাই। থ্যাঙ্ক য়ু।”

ট্রেনে আমার সামনে বসা দুই বয়স্ক যাত্রী নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমি আড়ি পাতিনি। অত বেয়াদব নই। কিন্তু ওঁদের উচ্চনাদের ওই কথোপকথন শুধু আমি নই, বোধহয় কামরার সবাই শুনেছে।

ট্রেনে কিছুই করার নেই – জানালা দিয়ে বাইরের শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়া। তাই ওই ‘cats and dogs’ আমার খালি মাথায় চিন্তার বীজ বুনে দিল।

বৃষ্টির সাথে কুকুর-বিড়ালের সম্পর্ক কী! হাজার ভেবেও কূল পেলাম না। আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে। কোনকিছু মাথার মধ্যে ঢুকলে তার জট না ছাড়ানো অবধি স্বস্তি পাই না।

অগত্যা গুগলের দরজায় টোকা দিলাম। যা পেলাম তা অবিশ্বাস্য।

কি, পৃথিবীর কোন প্রান্তে সত্যিই বৃষ্টির সাথে কুকুর-বিড়াল পড়েছিল?

না, ততটা হলে বাড়াবাড়ি হত নিশ্চয়ই। কিন্তু আসল ঘটনা কম রোমাঞ্চকর নয়।

ব্যাঙ-বৃষ্টি!

সার্বিয়া ২০০৫, জাপান ২০০৯, হাঙ্গেরি ২০১০, উরুগুয়ে ২০১১।

আসল কথায় যাওয়ার আগে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জেনে নেওয়া যাক।

প্রচণ্ড গরমে ভূপৃষ্ঠ দিনভর তেতে থাকার কারণে হালকা, গরম হাওয়া উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই গরম হাওয়া উপরে উঠে জমাট বেঁধে মেঘ তৈরি করে। এর ফলে কিছুটা তাপ মুক্তি পায়। এই তাপশক্তি এবার নিচের হাওয়াকে উপরদিকে উঠতে সাহায্য করে। একে বলা হয় ‘আপড্রাফট’ (updraft)। স্বভাবতই যত বেশি মেঘ জমাট বাঁধে, তত এই ‘আপড্রাফট’-ও বাড়তে থাকে।

উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে হাওয়ার গতিও সমানুপাতিকভাবে বাড়তে থাকে। নিচের হাওয়া ধীর আর তার উপরের হাওয়া দ্রুত। এই অবস্থায়, দ্রুততর হাওয়া নিচের জনের উপর গড়িয়ে গিয়ে গিয়ে ঘুরতে শুরু করে। ঘুরন্ত হাওয়ার চক্রগুলো একটা শোয়ানো সিলিণ্ডারের মত আড়াআড়িভাবে সজ্জিত হয়।

এদিকে নিচ থেকে গরম হাওয়া, মানে সেই ‘আপড্রাফট’ এসেই চলেছে। ফলে কি হয়? ‘আপড্রাফট’ ওই শোয়ানো সিলিণ্ডারটাকে ঠেলে উঠিয়ে লম্বা করে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেটাই ঘূর্ণির আকার নেয়। এবার সেটা মাটি ছুঁলেই টর্নেডো।

কিন্তু ব্যাঙ-বৃষ্টি? সেটা কিভাবে হচ্ছে?

ভণিতা শেষ। এবার আসল গল্প।

ধরা যাক, ওই ঘূর্ণিটিই একইভাবে কোনো সমুদ্রের উপর সৃষ্টি হল। তখন তাকে বলা হবে ‘ওয়াটারস্পাইট’ (waterspout)। বলা যেতে পারে এ হল টর্নেডোর ‘জলতুতো’ ভাই। এই ‘জল-ঘূর্ণি’-র বহির্ভাগে থাকে উচ্চচাপ আর কেন্দ্রস্থলে থাকে নিম্নচাপের একটা লম্বা সুড়ঙ্গ। আকাশ ও সমুদ্রের সেতু নির্মাণকারী এই ঘূর্ণি জলের সাথে জলচর প্রাণীগুলোকেও বিনা পয়সার যাত্রী হিসেবে নেয়। এই ভাবেই ‘ওয়াটারস্পাউট’-এর ভিতর বসে ব্যাঙবাবাজিরাও চলে যায় স্থান থেকে স্থানান্তরে।

একসময় ঝড় মাটি ছোঁয়। তার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। চাপ কমতে থাকে। তারপর আর কি? ঘূর্ণির ভিতর যা কিছু ছিল সবকিছুই সে উগরে দেয়।

এইভাবেই ব্যাঙ-বৃষ্টি হয়।

তবে শুধু ব্যাঙ না, পড়তে পড়তে দেখি মাছ, পোকা ইত্যাদি বর্ষণের খবরও দেশ-কাল ভেদে পাওয়া গেছে। আমাদের দেশেও মৎস্য-বৃষ্টির নজির রয়েছে।

তাহলে আর কি? চোখ রাখুন। কোনোভাবে যদি হঠাৎ পদ্মার ইলিশ আপনার বাড়ির উঠোনে পড়ে!

ছবি সৌজন্যঃ ব্রিটিশ শিল্পী জর্জ ক্রুকশ্যাঙ্ক।