মৃত্যু-শম্বুক

মৃত্যু-শম্বুক

অ্যানিমেটেড মুভি দেখতে ভালবাসেন? ড্রিমওয়ার্কসের-এর ‘টার্বো’ দেখেছেন? আর পাঁচটা শামুকের মতই একটা শামুক ছিল এই টার্বো। তার স্বপ্ন ছিল ‘রেসিং কার’ চ্যাম্পিয়ন হবে। কীভাবে হল, সেটা অবশ্য আজকের উপজীব্য নয়। তার জন্য চলচ্চিত্রটা দ্রষ্টব্য। ‘বিজ্ঞানভাষের’ এই কিস্তিতে টার্বোর কোন ভূমিকা নেই ঠিকই, কিন্তু আজকের প্রবন্ধের ‘যিনি’ প্রধান অতিথি ‘তিনি’-ও টার্বোর মতই ক্ষমতাবান।

আচ্ছা, শামুক দেখলে মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠে কোন ছবিটা ভেসে ওঠে? একটা ছোট মাংসপিণ্ডের উপর একটা খোল – তাই তো? রাস্তা বা ঘাসের উপর দিয়ে, স্লো-মোশনে, দুটো শুঁড় (যার ডগায় আসলে আছে চোখ) নাড়িয়ে নাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ঠিক যেন ‘আঠেরো মাসে বছর’-এর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আপনভোলা, অত্যন্ত গোবেচারা, সাত চড়ে রা-না কাড়া একটা জীব। ভয় পেলেই খোলের ভিতর শেঁধোচ্ছে। বিবর্তনের সিঁড়িতে এক অমেরুদণ্ডী প্রাণী এই শামুক। বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘মোলাস্কা’ (mollusca)-এর অন্তর্ভুক্ত ‘গ্যাস্ট্রোপড’ শ্রেণী (gastropod)-এর সদস্য।

কিন্তু ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে এই শামুকেরই এক আত্মীয় বাস করে, যে ছোটবেলায় পড়া বাংলা ব্যাকরণের ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ নিয়ম মেনে কোন কল্পিত যুদ্ধে সিংহকেও ঘায়েল করে দিতে পারে। অনেকটা যেন সেই গল্পে পড়া আদিবাসীদের ‘poison dart’ ছুঁড়ে শত্রু-নিধনের কায়দায়।

এই শামুকের নাম ‘কোন স্নেইল’ (cone snail)। প্রায় ন’শোর উপর প্রজাতি আছে এই মারণ-শামুকের, যার মধ্যে ‘টেক্সটাইল কোন’ (textile cone) এবং ‘জিওগ্রাফি কোন’ (geography cone) সবচেয়ে বিষধর। পিঠের বাহারি, চিত্রাঙ্কিত খোলটি শঙ্কু আকৃতির বলেই এর এই নামকরণ। কিন্তু খোলের বৈচিত্র্যে মজলে বিপদ অনিবার্য। শিকার এরা সাধারণত করে রাতের দিকে। জলের তলায় নুড়িপাথরের নিচে ঘাপটি মেরে থাকে – ঠিক যেন লুকোনো সাবমেরিন। তারপর শত্রুর জাহাজ দেখলেই অতর্কিতে টর্পেডো হানে!

শুঁড়ের ডগায় দুটো চোখ থাকলেও, ‘কোন স্নেইল’-এর ‘ইনফর্মার’ হল তার ঘ্রাণশক্তি। এর মুখের গোড়ায় একটা নলের মত অঙ্গ থাকে, যাকে বলা হয় ‘প্রোবোসিস’ (proboscis)। এটাকে মর্জিমতন সামনে বাড়িয়ে, শিকারের অস্তিত্ব অনুভব করে, এই শামুক বিদ্যুৎবেগে তার বিষাক্ত হার্পুন নিক্ষেপ করে শিকারের গায়ে। হার্পুন বললেও এটি আসলে এক ধরণের দাঁত (radular tooth)। এর মাধ্যমেই বিষগ্রন্থী মারফত নিউরোটক্সিন শিকারের শরীরে প্রবেশ করে। নিউরোটক্সিন এমন বিষ, যা স্নায়ু ও পেশীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরই ফলে শিকার চলৎশক্তিরহিত হয়ে পড়ে। ‘কোন স্নেইল’-এর বিষের ‘বিশেষত্ব’ হল, এটি নির্দিষ্ট, এক প্রকারের বিষ নয়। বরং বিভিন্ন বিষের সংমিশ্রণ। ‘কোন স্নেইল’-এর প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে এই মিশ্রণ পৃথক। কার কি খাদ্যাভ্যাস, তার ভিত্তিতেই বহু প্রজন্মের বিবর্তনে, মিশ্রণের এই তারতম্য সৃষ্টি হয়েছে। বিষক্রিয়ায় শিকার অসাড় হয়ে গেলে ‘মৃত্যু-শম্বুক’ (না, এই নাম শব্দকোষে নেই) মুখ হাঁ করে তাকে গিলে খায়। কিছু ঘণ্টা পরে ‘কোন স্নেইল’ খাবারের দুষ্পাচ্য অংশ এবং ব্যবহৃত হার্পুনটি ‘ঢেকুর’ তুলে পরিত্যাগ করে এবং পরবর্তী শিকারের আগে তূণীর থেকে নতুন একটি হার্পুন যথাস্থানে ‘রিলোড’ করে।

তবে শুধু জলজ প্রাণীই নয়, কিছু কিছু ‘কোন স্নেইল’-এর বিষ এতই শক্তিশালী যে মানুষও সেই হার্পুনের খোঁচায় আহত হয়ে মারা যায়। তবে টিভি সিরিয়ালের মত কোনকিছুই তো ‘সম্পূর্ণ ভাল’ বা ‘আগাগোড়া বাজে’ হয় না প্রকৃতির রাজ্যে! কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতই এই নিউরোটক্সিন দিয়েই ‘অ্যালজহাইমার্স’ বা ‘পার্কিনসনস’-এর মত স্নায়ুজনিত রোগ-প্রতিকারের অভিযানে নেমেছেন গবষেকরা। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতেই হয়ত ধন্বন্তরির আবির্ভাব হবে!