মৌমাছির নাচ

মৌমাছির নাচ

“বহুকাল আগে একটি পত্রিকাতে কার্ল ভন ফ্রিশ-এর বই ‘The Dance Language and Orientation of Bees’ অবলম্বনে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। অস্ট্রিয়ান entomologist – মানে পোকামাকড়ের বিশেষজ্ঞ – ছিলেন এই ভন ফ্রিশ। মৌমাছির চালচলন যদি কখনো লক্ষ্য করিস দেখবি কী ইন্টারেস্টিং!”

আমাদের অ্যাডিশনাল বায়োলজির ক্লাস চলছিল। সেদিনের বিষয় ছিল honey-bee বা মৌমাছি। কিন্তু মূল আকর্ষণ তো স্কুলের ‘সিধুজ্যাঠা’, পরলোকগত শ্রী অজিত কুমার সেনগুপ্ত স্যার ওরফে অজিতদার (বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে উইকিপিডিয়া) ঈর্ষণীয় জ্ঞানভাণ্ডার। ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’ বই তো গতানুগতিকতার প্রতীক। সেটা পাশেই বন্ধ করে রাখা।

মৌমাছি যে সমাজবদ্ধ, শ্রেণিবদ্ধ, কর্মকুশল জীব – তা অবশ্য অনেক আগেই জানতাম। যেটা জানতাম না, সেটাই আজকের উপজীব্য। তা অপার বিস্ময় জাগায়। প্রকৃতি যে কত নিপুণভাবে প্রাণীজগতের জীবনধারণকে ‘প্রোগ্রাম’ করে রেখেছে তার অন্যতম উদাহরণ – মৌমাছির নাচ।

‘মনে কর, একটা মৌমাছি একটা ফুলে বসেছে। টাটকা মধু আর পরাগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের চাকে ফিরে যাবে। মৌমাছি পরার্থপরতায় বিশ্বাসী। খবরটা চাকের বাকিদের জানাতে হবে তো!

বেশ, ফিরে তো গেল।

কিন্তু জানাবে কি ভাবে? তোর-আমার মত কথা তো বলতে পারে না। না আছে মর্স-কোড না আছে ন্যাটোর ফোনেটিক অ্যালফাবেট। এখানেই ভন ফ্রিশের অবদান। তিনি একটা স্টাডি করেন। সেই পর্যবেক্ষণে ভন ফ্রিশ আবিষ্কার করেন এই মৌমাছির নাচ। এই ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’-এর মাধ্যমেই ওই বার্তাবাহক মৌমাছিটা বাকিদের সাথে যাবতীয় তথ্য শেয়ার করবে। ভাবতে পারিস, এটা একটা সুঠাম এনক্রিপশান-ডিক্রিপশান পদ্ধতি। প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনেই হয়ে চলেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেই গেছেন – ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু’।”

আমরা মৃদু হাসলাম।

‘এবার এই নাচের তাৎপর্যটা বোঝার চেষ্টা কর। মৌমাছিটা কিন্তু প্রতিবার একভাবে নাচে না।’

আমাদের কিশোর মনে কৌতুহল জাগাতে অজিতদা আরও খানিকটা সামনে ঝুঁকে বললেন, ‘ধর, মৌমাছিটা যদি নেচে নেচে ১৮০ ডিগ্রিতে ঘুরপাক খায় তাহলে বাকিরা বুঝবে যে সূর্যের ১৮০ ডিগ্রিতে অর্থাৎ সূর্যের অবস্থানের ঠিক উল্টো দিকেই ফুলটা অবস্থিত। আবার যদি ২৭০ ডিগ্রিতে ঘোরে, তাহলে বুঝতে হবে যে সূর্য যেদিকে, তার বাঁদিকে যেতে হবে।

এই নাহয় গেল ‘দিক’।

কিন্তু দূরত্বের হিসাব কিভাবে বোঝা যাবে?’

একটু থামলেন অজিতদা। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁ করে ওঁর ‘science of life’ শুনছি। উনিই আবার খেই ধরলেন।

‘মৌমাছিটা যদি এক সেকেণ্ড সময় ধরে ওইভাবে ঘুরতে থাকে বা বলা যাক নাচতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে গন্তব্য ৭৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। মৌমাছিদের হিসেব অনুযায়ী আমাদের এক সেকেণ্ড মানে ওদের প্রায় ৭৫০ মিটার দূরত্ব।

তাহলে কি দাঁড়াল? দাঁড়াল এই, যে মৌমাছি বলছে, ‘ভাই সকল, সূর্যের উল্টোদিকে, আমাদের চাক থেকে ৭৫০ মিটার দূরে একটা দারুণ প্লট দেখে এসেছি। থোকা থোকা ফুল ফুটে আছে। চল, সেখান থেকে মধু নিয়ে আসি।”

প্রকৃতির বানানো অ্যালগোরিদম নিজেদের মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠে বায়োস্কোপের মত পরিস্কার দেখতে পেয়ে তাজ্জব হয়ে আছি।

অজিতদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মজা করে বললেন, “এরা কিন্তু তোদের মত কে.সি.নাগের অঙ্ক শিখে আসেনি। তাও ক্লকওয়ার্কের মত প্রতিদিন নির্ভুলভাবে খাদ্যান্বেষণ করছে।

স্রেফ একটা নাচের মাধ্যমে। Waggle dance। আমাদের ওই লারে-লাপ্পা তো নয়!”

 

ছবি সৌজন্যঃ কসমস ম্যাগাজিন