বিশ্ববীণারবে/ পর্ব ১

বিশ্ববীণারবে/ পর্ব ১

আলোর গতি, আলোকবর্ষ আর মৃত তারাদর্শন

এই মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি গতিতে চলে আলো। শূন্যস্থানে আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। আলোর এই অসম্ভবরকমের বেশি গতি আমরা মোটেই বুঝতে পারি না।
বহুদূরের কোনও তারা থেকে যে আলো আসে পৃথিবীতে, বা আমাদের চোখে, তা অতিক্রম করে আসে লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পথ, কখনও কখনও লক্ষ বদলে যায় কোটিতেও। এখন এত বড় বড় সব দূরত্ব যদি আমরা কিলোমিটার এককে লিখতে যাই, তাহলে আমাদের বিরাট বড় বড় সব সংখ্যা লিখতে হবে, যা সময় বেশি নেবে, আবার পরিশ্রমও। যেমন, আমাদের সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক বস্তু, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ রয়েছে তিন লক্ষ পঁচাশি হাজার কিলোমিটার দূরে, সূর্যের দূরত্ব প্রায় পনেরো কোটি কিলোমিটার। আবার সূর্য ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরি রয়েছে চল্লিশ হাজার বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, যাকে সংখ্যায় লিখলে লিখতে হয় ৪০,০০০,০০০,০০০,০০০ কিলোমিটার। অবশ্য একে কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে লেখা চলে এইভাবে- ৪০×১০^১২ কিলোমিটার। তবু কিলোমিটার একক যে মহাকাশে দূরের তারাদের অবস্থান পরিমাপের জন্য বেশ অসুবিধাজনক, সেটা আশা করি বোঝা যাচ্ছে।
ঠিক এই অসুবিধার কথাই চিন্তা করে জার্মান জ্যোতির্বিদ ফ্রেডারিখ উইলহেল্ম বেসেল ১৮৩৮ সালে প্রস্তাব দিলেন, আলোর গতি যদি অত বেশিই হয়, তাহলে আলোর বেগকেই দূরের বস্তুর দূরত্ব মাপবার কাজে লাগানো হোক না?
তিনিই প্রথম ব্যবহার করলেন আলোকবর্ষর আইডিয়া। বললেন, একটা গোটা বছরে আলো যে পথটা অতিক্রম করবে, সেটা তো নেহাত অল্প না, সেটাকেই ধরা হোক একটা একক হিসেবে। আর এই নতুন পদ্ধতিতে ৬১ সিগনি নামে একটি যুগ্ম-তারার দূরত্ব মেপে জানালেন, ১০.৩ আলোকবর্ষ। আলোর গতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার ধরে এক বছরের তুল্য সেকেন্ড সংখ্যাকে ওই মানের সঙ্গে গুণ করে পাওয়া যায় যে এক আলোকবর্ষ মানে ৯.৪৬১×১০^১২ কিলোমিটার, বা প্রায় দশ হাজার বিলিয়ন কিলোমিটার।
আলোকবর্ষের আরও একটা সুবিধা, এই একক খুব সহজেই জানিয়ে দেয় ওই দূরত্বে থাকা মহাজাগতিক বস্তুটি (তারা হোক বা গ্যালাক্সি) থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে কত সময় নেবে।
আর এখানেই সেই বিশেষ ব্যাপারটা খেয়াল হয় আমাদের। একটা দূরের তারা যদি পৃথিবী থেকে তিরিশ আলোকবর্ষ দূরত্বে থাকে, সেটার অর্থ, ওই তারাকে আমি যদি এখন দেখি, তবে এখন আমাদের চোখে তারাটি থেকে যে আলো এসে পৌঁছচ্ছে, সেই আলো তারাটি থেকে আসলে নির্গত হয়েছিল তিরিশ বছর আগে!
এই ব্যাপারে আর দুটো কথা বলব। এক, আমরা আকাশের দিকে চোখ রাখলে যে তারাদের দেখি, সেগুলোর মধ্যে এমন অনেক তারা আছে, যেগুলো রয়েছে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে। এখন একটা তারার আয়ুষ্কাল যেহেতু অসীম নয়, তারও দেহান্ত ঘটে, সুতরাং আমরা মিশ্চিতভাবেই এমন কিছু তারা দেখতে পাই, যেগুলো আজ আর জীবিতই নেই। অনেক কোটি বছর আগেই নিভে যাওয়ার আগে তার দেহ থেকে নির্গত শেষ আলোটি হয়ত এই মূহুর্তেই আমাদের চোখে এসে পৌঁছল।
দুই, টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা যে দূরের তারাদের দিকে ফোকাস করে সেগুলোকে দেখি, ওই দেখা আসলে তারার অতীতের কোনও একটা পর্যায়কে দেখা। আর এই হিসেবে টেলিস্কোপ যন্ত্রটিকে আমরা “অতীতদর্শনী যন্ত্র” বা “সময়ভ্রমণকারী যন্ত্র” ও বলতে পারি।
আকাশের বুকে এমন আরও অজস্র রহস্যময় ব্যাপার লুকানো রয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে সেইসব রহস্যময় জগতে প্রবেশ করব আগামী পর্বগুলিতে।(চলবে)