এক আবিষ্কার, পিছনে চারজন

এক আবিষ্কার, পিছনে চারজন

এক আবিষ্কার, পিছনে চারজন

মানুষকে বাঁচাল কি না কষাইখানার মৃত পশুর শরীর থেকে সংগ্রহ করা দেহরস!

কানাডার ১৪ বছরের কিশোর লিওনার্দো থমসনের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছিল যে!
লিওনার্ডের বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছে ছেলেটি। মাত্রার ১৪ বছরেই রক্তের মাত্রাতিরিক্ত শর্করা বিকল করতে শুরু করেছে একের পর এক অঙ্গ। ওই সময় ডায়াবেটিস মানেই ছিল অবধারিত মৃত্যু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কষাইখানা মৃত পশুটিই বাঁচিয়ে দিল লিওনার্দোকে ।

কি এমন ছিল ওই মৃতপশুর দেহরসে মা অমৃতের মতো কাজ করল ওই কিশোরের শরীরে? আসলে ওই মৃত পশুর প্যাঙক্রিয়াস বা অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন বের করে এনে চিকিৎসকেরা তা প্রয়োগ করেছিলেন লিওনার্দোর শরীরে।

সেটা আজ থেকে ৯৯ বছর আগেকার কথা। ১৯২২ সালের ২৩ জানুয়ারি লিওনার্দোর শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এক বছর আগে হলেও ওই কিশোরকে বাঁচানো যেত না। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস হলেই চিত্রগুপ্তের খাতায় রোগীর নাম লেখা হয়ে যেত। আসলে ১৯২১ সালের ২৭ জুলাইয়ের আগে কেউ জানত না যে প্যাঙক্রিয়াস থেকে ইনসুলিনকে আলাদা করে এনে তাকে ডায়াবেটিস সারানোর জন্য ব্যবহার করা যায়।

ঠিক ১০০ বছর আগে ওই দিনটিতেই কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে অধ্যাপক জন ম্যাকলিডের গবেষণাগারে এক শল্য চিকিৎসক ফেডেরিক বেন্টিং ও রক্তে গ্লুকোজের পরিমাপের কাজে পারদর্শী ডাক্তরি ছাত্র চার্লস বেস্ট একটি কুকুরের প্যাঙক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন‌ বের করে গোটা বিশ্বকে চমকে দিলেন।

ওই কুকুরটির প্যাঙক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন বের করে আনার পরে তার শোধন করে এমন একটি কুকুরের শরীরে প্রবেশ করানো হয় তার প্যাঙক্রিয়াসটি আগেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বলে তার রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত গতিতে বেড়ে যাচ্ছিল। পরীক্ষার ফল কি হবে তার জানা ছিল না বেন্টিং, ম্যাকলয়েড আর বেস্টের। কিন্তু দেখা যায় প্যাঙক্রিয়াস না থাকা কুকুরটির করতে শর্করার পরিমাণ নামছে দ্রুত গতিতে।

ওই তিনজনের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল মানবদেহে প্রয়োগ করার উপযুক্ত ইনসুলিনের সন্ধান‌ করা। তাঁদের সেই কাজটা সহজ করে দেন জৈব রাসায়ানবিদ জেমস কলিপ। কলিপ পশুর প্যাংক্রিয়াস থেকে সংগ্রহ করা ইনসুলিন শোধন করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। মানুষের প্রয়োগ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। আর সেই পরিশোধিত ইনসুলিনই দেওয়া হয়েছিল কিশোর লিওনার্দোকে।

প।রাণীর শরীর থেকে ইনসুলিন যে বের করা যায় সেই ধারনা বেন্টিংয়ের মাথায় ঢোকে ১৯২০ সালের অক্টোবরে। একটি মেডিক্যাল জার্নালের একটি নিবন্ধ বেন্টিংয়ের মাথার পোকা নাড়িয়ে দিয়েছিল। পড়েছিলেন, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস প্যাঙক্রিয়াস বা অগ্নাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহান্স নামের যে কোষগুলি ইনসুলিন তৈরি করে সেগুলিকে নষ্ট করে দেয়। ওই নিবন্ধে এক জায়গায় লেখা ছিল, ইনসুলিন তৈরির এই কোষগুলির নিষ্ক্রিয় হওয়ার গতি প্যানক্রিয়াসের অন্যান্য কোষের তুলনায় অনেক কম। বেণ্টিং বুঝতে পারেন যে ইনসুলিন তৈরির কোষগুলি প্যাঙক্রিয়াসের অন্য কোষগুলি থেকে আলাদা। অর্থাৎ ওই কোষগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলিকে বের করে আনা সম্ভব। এই কাজে সফল হলে ওই কোষগুলি থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ করা যাবে।

১৯২১ সালের ১৭ই মে বেণ্টিং, বেস্ট এবং ম্যাকলিড তাঁদের গবেষণার কাজ শুরু করেন। ৭০ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৭ জুলাই ওই তিন গবেষকের স্বপ্ন‌ পূর্ণ হয়।কুকুরের প্যাঙক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন বের করার পদ্ধতি মানুষের আয়ত্তে চলে আসে।

লিওনার্দোর উপরে পরীক্ষা সফল হওয়ার পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে। এই আবিস্কারের জন্য বেণ্টিং এবং ম্যাকলয়েড ১৯২৩ সালে চিকিৎসা বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তখনও স্নাতক না হওয়ায় নিয়মের লাল ফিতের ফাঁসে বেস্টের ভাগ্যে নোবেল পুরস্কার জোটেনি। বেণ্টিং তাঁর পুরষ্কারের অর্ধেক অর্থ বেস্টের সঙ্গে এবং ম্যাকলয়েড তার পুরষ্কারের অর্ধেক কলিপের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন।