পৃথিবীর জলের উৎস সুর্যের ধুলোকণা!

পৃথিবীর জলের উৎস সুর্যের ধুলোকণা!

পৃথিবীর রং আসলে ঠিক কীরকম সেটা এখনও কিন্তু অজানাই। একটা নীল রঙের আভা যে রয়েছে সেটা অবশ্য মোটামুটি সকলেই মানেন। তার কারণও রয়েছে। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ জল। তাই গবেষকদের এই সিদ্ধান্তে আসতে সুবিধে হয়েছে যে জলের জন্যই নীল রঙের আভাটা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু জলের উৎস নিয়ে বিজ্ঞানসমাজে অনন্তকাল ধরে রয়েছে অপার কৌতূহল আর বিতর্ক।
বৈজ্ঞানিকরা বিভিন্ন সময়ে জলের উৎস সম্পর্কে নানারকমের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিছু গবেষকের যুক্তি সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে ধুলো ঘূর্ণায়মান মেঘ এবং গ্যাস থেকে একত্রিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীতে জল কোনও না কোনওভাবে উপস্থিত রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, পৃথিবীকে বলা হয়েছে এক বিশাল জলাধার। কিন্তু বিজ্ঞানীদের একাংশ জানাচ্ছে আদিকালে, জন্মলগ্নে পৃথিবী শুকনোই ছিল। মহাসাগরগুলোর সৃষ্টি অনেক পরে হয়। সেই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বর্হিজাগতিক উৎস থেকে পৃথিবীতে বরফ ও জলের আবির্ভাব হয়েছিল বৃষ্টিরূপে। এই মুহুর্তে পৃথিবীতে থাকা জলের পরিমাণ ৩৩২, ৫০০,০০০ কিউবিক মাইল! তার পুরোটাই বর্হিজাগতিক উৎস থেকে আবির্ভাব হয়েছিল বলে যে ধারণা বিজ্ঞানীদের একাংশ পোষণ করেছিলেন সেটা কিন্তু নিশ্চিত নয়, বিতর্কও রয়েছে সেই নিয়ে।
সম্প্রতি ব্রিটেনের একদল বিজ্ঞানী এই বিতর্কিত মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন। পদার্থের দানা অধ্যয়ন করার পর ২৫১৩ ইতেকাওয়া নামের একটি গ্রহাণুরও সন্ধান পেয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে একটি জাপানি রোবটের সহায়তায় পরীক্ষা করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে সমুদ্রের সৃষ্টি বাইরের কোনও উৎস থেকেই।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লুক ডালি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমরা যে ধুলো নিয়ে গবেষণা করছি তার থেকেই পরিষ্কার আমাদের মহাসাগরগুলো সৌরজগতের অন্যান্য অংশ থেকে আসা জলে সৃষ্টি হয়েছে।” ডালির আরও দাবি, “গবেষণা থেকে একটা ছবি পরিষ্কার যে, পৃথিবীতে থাকা অন্তত অর্ধেক জল আন্তঃগ্রহের ধুলো থেকে ফিল্টার করা হয়েছে।”
২৫১৩ ইতেকাওয়া থেকে ধুলোর দানা নিয়ে গবেষণা করার জন্য ডালি এবং তার সহযোগীরা টোমোগ্রাফির আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই চমকপ্রদ প্রক্রিয়ার সহায়তায় বিজ্ঞানীরা একটি একটি করে পরমাণুর নমুনা গুণতে পারেন। আর এই পরীক্ষার মাধ্যমেই বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, গ্রহাণু থেকে পাওয়া ধুলোর কণাগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জল রয়েছে। ডালির এই গবেষণা নেচার অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। ডালির দাবি, এই জল হয়ত সৌরবায়ু দ্বারা তৈরি হয়েছিল যা আদতে সুর্য থেকে প্রবাহিত কণার একটা প্রবাহ। এই কণাগুলো, ডালির পর্যবেক্ষণে সৌরজগতে ভেসে থাকা ধুলোর মেঘে যে অক্সিজেন রয়েছে তার পরমাণুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে জলের অণু তৈরি করেছিল। সেটা শেষপর্যন্ত বহুবছর ধরে সৌরজগতেই থাকা মেঘের মধ্যেই তৈরি হয় এবং ধুলোকণাগুলি তাদের মধ্যে থাকা সমস্ত জলকে মুছে ফেলেছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বলা সেই অমোঘ বাক্যকেই পরোক্ষে সমর্থন করলেন বিজ্ঞানীরা। দ্য ভিঞ্চি বলেছিলেন, ‘জলই পৃথিবীর আসল চালিকাশক্তি।
তাৎপর্যের বিষয়, সুর্যকে প্রদক্ষিণ করা অন্যান্য গ্রহ বা নক্ষত্র এই জল বহনকারী দানাগুলিকে ভাসিয়ে তুলত। পৃথিবীতে সিলিকেটের এই ছোট টুকরোগুলো অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শুধু কিছু দানা অবিচ্ছিন্নভাবে বায়ুবিহীন গ্রহাণু ইতেকাওয়ার ওপর পড়ছিল বিলিয়ন বছর ধরে। জাপানি রোবটের সহায়তায় একটি নমুনা তৈরি হয় এবং পৃথিবীতে সেটা ফিরেও আসে।
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়েরই আর এক গবেষকের নাম প্রফেসর মার্টিন লি। তিনি অবশ্য জানাচ্ছেন, সমুদ্রের সব জল সুর্য-সৃষ্ট ধুলোকণা থেকে তৈরি হয়েছে সেটা ভাবা ভুল হবে। তার মতে পৃথিবীতে বিধ্বস্ত হওয়া ধূমকেতু এবং গ্রহাণুগুলির বরফ থেকেও সমুদ্রের জল উৎপত্তি হয়েছে।
তবে এই আবিষ্কার কিন্তু বিজ্ঞানসমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। পৃথিবীতে জলের উৎস সম্পর্কে এই আবিষ্কারের পেছনে প্রমাণও দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানীরা বলছেন এই আবিষ্কারে জলের সঙ্গে জীবনের সম্পর্কের উৎসের কথাও ভবিষ্যতে জানা যেতে পারে।