মারণ ভাইরাসের উৎসস্থল মেক্সিকো!

মারণ ভাইরাসের উৎসস্থল মেক্সিকো!

সময় যত এগিয়েছে, মানবসভ্যতার তথাকথিত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর জল ও বায়ুরও দূষণের পরিমাণ বেড়েছে, এখনও বেড়ে চলেছে। তার আপাত-প্রতিফলন, মানুষের অসুস্থতার ব্যাপ্তিও বেড়েছে! আর্বিভাব হয়েছে বিভিন্নরকমের রোগ জীবাণুর। জীবাণুসভ্যতারও উন্নয়ন হয়েছে! এই উন্নয়নের প্রতিফলন? ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস! আধুনিক যুগের আধুনিক দু’টি জীবাণু। যার মোকাবিলা করতে গিয়ে চিকিৎসক, বিজ্ঞানীদের রাতের ঘুম চলে গিয়েছে! এই দু’টি জীবাণুর প্রতিনিয়ত গিরগিটির মত রূপ ও চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নাজেহাল বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞান! একশো বছর আগের যে মহামারী হয়েছিল প্লেগ রোগের কারণে, সেটাও ছিল এক ভাইরাসের উপহার মানবসভ্যতাকে। আবার একশো বছর পর ২০২০-তে বিশ্ব জুড়ে যে মহামারীর ঝাপটায় মানবসভ্যতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান বেসামাল হয়ে পড়ল সেই কোভিড-১৯-ও এক ভাইরাসের উপহার মানবসভ্যতাকে!
অনেক বছর ধরে চলছে এক গবেষণা। সম্প্রতি সেই গবেষণাটি প্রকাশ হয়েছে একটি বিজ্ঞানের জার্নালে। গবেষণার মূল বিষয়বস্তু, যে ভাইরাসের ধাক্কায় আমরা বেসামাল হয়ে পড়েছি ২০২০ থেকে, সেই ভাইরাসের উৎসস্থল কোথায়, ভাইরাস এই পৃথিবীতে এল কীভাবে? কবেই বা তার দাপট শুরু হয়েছিল? গবেষণা করছেন মেক্সিকো, ডেনমার্ক আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা সম্মিলিতভাবে। তাঁদের সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন মেক্সিকোর ভূতত্ববিদরাও। মেক্সিকো শহরের খননকার্য চালিয়ে তারা মাটির তলায় পেয়েছেন দু’টি হাসপাতাল আর একটি চার্চ! দু’টি হাসপাতালের একটিতে যতগুলি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে সেগুলির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে একটা অনাবিষ্কৃত তথ্য এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন।
প্রচুর সংখ্যায় যে ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা মেক্সিকো ও আমেরিকায় পা রেখেছিল তাদের মাধ্যমেই প্রথম ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল বিভিন্ন রকমের ভাইরাস! সালটা ১৫৭৬। ষোড়শ ও সপ্তম শতাব্দীতে আমেরিকা, মেক্সিকো জুড়ে প্রবেশ করেছিল প্রচুর সংখ্যায় ইউরোপীয় উপনিবেশকারী, যাদের অধিকাংশই ছিল ক্রীতদাস। সেই সময় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার অন্যতম একটা ছবি ছিল ট্রান্স-আটলান্টিক ক্রীতদাস বেচাকেনার ব্যবসা। ইউরোপ থেকে আমেরিকা, মেক্সিকো জুড়ে যে ক্রীতদাসদের বিক্রি করা হত তারা ছিল মূলত পশ্চিম আফ্রিকার। তাদের মধ্যেই প্রথম দেখা গিয়েছিল বিভিন্নরকমের ভাইরাসজনিত অসুখ। বিজ্ঞানীরা কঙ্কালগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেছেন, ১৫৭৬-এ আমেরিকা জুড়ে এক অসুখের মহামারী হয়েছিল। তার ভাইরাসের নাম কোকোলিজ। প্রচুর স্থানীয় মানুষ মারা যায় ওই মহামারীতে। যে ২১জনের মধ্যে কোকোলিজের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে কঙ্কালগুলোর ডিএনএ পরীক্ষা করে তাদের সকলেই ছিল পশ্চিম আফ্রিকার। ক্রীতদাস হয়ে তারা প্রবেশ করেছিল মেক্সিকোয়। তাদের মাধ্যমেই সেই সময় মেক্সিকো এবং আমেরিকা জুড়ে মহামারীর উৎপত্তি। কোকোলিজ ছাড়াও ওই সময় কিছু ক্রীতদাসের শরীরে পাওয়া গিয়েছিল পার্ভো নামের আরও এক ভাইরাসের অস্তিত্ব, পাওয়া গিয়েছে হেপাটাইটিস ‘বি’-এর ভাইরাসের অস্তিত্ব। গবেষণা আরও জানিয়েছে যে, ওই ভাইরাসগুলোকে দূরদূরান্তে থাকা মানুষের শরীরেও ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে। দূরদূরান্ত মানে, বিজ্ঞানীরা ওই সময় এই ভাইরাসকে ব্রাজিলের আমাজনে যেমন খুঁজে পেয়েছেন, ভারতেও তার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। গবেষণা বলছে, প্রথম ও দ্বিতীয়, দু’টো বিশ্বযুদ্ধ ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে! শিল্প বিপ্লব এবং তার পরবর্তী যুগে প্রযুক্তি বিপ্লবকে সঙ্গে নিয়ে মানুষ তার উন্নয়নের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান হয়ে উঠছিল। সে ভাবেনি ওই প্রবাদের মত বাক্যটির কথা, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। ভাইরাস তার চরিত্র আর চেহারা বদলে তখনকার কোকোলিজ থেকে আজকের করোনার রূপান্তরিত হয়ে নিঃশব্দে মেরে চলেছে মানুষ। এত বছর পর মানবসভ্যতার টনক নড়ল। পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে, উষ্ণায়ন কমাতে হবে, উদ্ভিদ ধ্বংস করলে চলবে না– এরকম নানান কর্মসূচী এখন মানুষের মাথায়। সময়ই এর উত্তর দেবে যে শেষ পর্যন্ত ভাইরাস দমন করা গেল কি না!