চড়াই বাঁচিয়ে বেঙ্গালুরুর ‘চড়াইমানব’ এডউইন জোসেফ

চড়াই বাঁচিয়ে বেঙ্গালুরুর ‘চড়াইমানব’ এডউইন জোসেফ

ঘিঞ্জি শহরের বুকে প্রকাণ্ড

এক বাড়ি। তার চারপাশের অন্য বাড়িগুলোর থেকে এই বাড়িটির চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। কাঠা ছয়েক জমির ওপর গড়ে ওঠা বাড়িটা যেন আস্ত একটি বাস্তুতন্ত্র। গাছ-পালার সবুজ আচ্ছাদন যেমন ঢেকে রেখেছে গোটা বাড়িটিকে, তেমনই পাখির ডাকে মুখরিত হয়ে রয়েছে তার আনাচকানাচ।
বেঙ্গালুরুর থমাস টাউনের গসপেল স্ট্রিট। সেখানে গেলেই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বাড়িটি। চিরায়ত শহরজীবনে এক ব্যতিক্রমী ছবি। বাড়ি তৈরির নেপথ্যের নায়কের নাম এডউইন জোসেফ। বয়স ৭৪ বছর। পেশায় তিনি প্রাক্তন প্রযুক্তিবিদ। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তার লড়াই চলছে চড়াই পাখির সংরক্ষণের জন্য।
শহর তো বটেই, গ্রামাঞ্চল থেকেও যেন ক্রমশ উধাও হয়ে যাছে চড়াই পাখির অস্তিত্ব। শুধু বাংলা নয়, গোটা ভারতের ছবিটাই একইরকম। জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, দূষণ, নগরায়ন, পুরনো বাড়ি ভেঙে মাল্টিপ্লেক্স, জলাশয় বুজিয়ে ফেলা— এই সমস্ত কিছুই অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে ঢেলে দিচ্ছে ছোট্ট প্রজাতিটিকে।
চড়াই মূলত বাস্তুঘেঁষা পাখি। সাধারণত অরণ্যে কিংবা গাছে বাসা বাঁধে না তারা। বরং আশ্রয় নেয় বাড়ির ঘুলঘুলি কিংবা পুরনো নির্মাণের ফাঁক-ফোকরে। শৈশব থেকে এই দৃশ্য দেখেই বড়ো হয়েছেন জোসেফ। তাঁর একান্নবর্তী পরিবারেও বাসা বাঁধত চড়াই পাখি। তবে বিশ শতকের শেষের দিক থেকে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। নগরায়নের জেরে ক্রমশ সংখ্যা কমতে থাকে চড়াইয়ের। পুরনো বাড়ি ছেড়ে নিজেও বাসা বদল করেছিলেন জোসেফ। প্রকৃতির এই বদলটা তাই যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল তাঁর সামনে।
২০০৮-এ চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। আর তারপরেই হাত লাগান প্রকৃতি সংরক্ষণে। হারিয়ে যেতে বসা চড়াইদের ফিরিয়ে আনতে শুরু হয় তাঁর লড়াই। বাসস্থানের হদিশ দিতে নিজের বাড়িতেই গড়ে তোলেন ছোটো-খাটো একটি অরণ্য। দেবদারু থেকে শুরু করে নানান প্রজাতির গাছগাছালি রোপণ করেন জোসেফ। সঙ্গে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এমনকি বাগানেও কৃত্রিমভাবে তৈরি করেন চড়াইদের থাকার জায়গা। তাদের জন্য অ্যামিউজিং পার্ক!
চড়াইদের খেলার জন্য কৃত্রিম ঝর্ণা, জলাশয়, গোলকধাঁধাঁ, হ্যাঙ্গিং নেস্ট— এই সবকিছুই নিজে হাতে বানিয়েছেন জোসেফ। তাতে ফলও মিলেছে। ক্রমশ চড়াইদের আনাগোনা বেড়েছে তাঁর বাড়িতে। বর্তমানে তাঁর বাড়িতে অন্তত ২৫০ চড়াই পাখির বাসস্থান। দু-বেলা তাদের খাবার এবং পানীয় সরবরাহের দায়িত্বও নিয়েছেন জোসেফ। ঈগল কিংবা অন্যান্য শিকারি পাখিদের থেকে বাঁচাতে গোটা বাড়িকে ঢেকে ফেলেছেন লোহার তারজালে!
ইতিমধ্যেই একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বীকৃতি জানিয়েছে তাঁর এই উদ্যোগকে। পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা, শংসাপত্র। হয়ে উঠেছেন ‘স্প্যারো হুইসপারার’, ‘স্প্যারোম্যান অফ বেঙ্গালুরু’। মাস খানেক আগে ছিল আন্তর্জাতিক চড়াই দিবস। সেদিন বেঙ্গালুরুর এক স্কুলের ছাত্রী নিজের হাতে কৃত্রিম বাসা বানিয়ে উপহার দিয়েছিলেন জোসেফকে। দেশ-বিদেশের স্বীকৃতির থেকেও এই উপহারে আপ্লুত জোসেফ। তাঁর এই উদ্যোগ, এই লড়াই তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে যে। জোসেফের কাছে সেই সাফল্যের আনন্দ যেন অনেক মূল্যবান তথাকথিত পুরষ্কারগুলোর চেয়ে!