বিজ্ঞানই সংস্কৃতি

বিজ্ঞানই সংস্কৃতি

সংস্কৃতি হচ্ছে -সম্মার্জনী লইয়া প্রয়োজনীয় বস্তুকে নিষ্ক্রান্ত করার পর যে সব অপ্রয়োজনীয় বস্তু পড়িয়া থাকে, যেমন দর্শন,সাহিত্য, ইতিহাস,সংগীত,নাট্য ও অন্যান্য ললিতকলা, ছায়াছবি, এটাই একটি গোষ্ঠী বা সমাজের সামগ্রিক সংস্কৃতি। এর চর্চার মাধ্যমে কিছু মানুষ প্রভূত আনন্দ ও নান্দনিকতার স্পর্শ অনুভব করেন। এছাড়া সংস্কৃতির কোনও মূল্য নেই। এখন কিন্তু খেলাধুলাও আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ।
আধুনিক বিজ্ঞান যখন বাংলায় প্রবেশ করেছিল তখন সেটা প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না। অর্থাৎ ওই উপনিবেশিকতার আওতায় শিশুর মতই বিজ্ঞান বাংলায় প্রবেশ করেছিল। প্রথমে কলকাতার কলেজগুলি ও কলকাতা সংলগ্ন কলেজ যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজ, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, শ্রীরামপুর কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। বিশ্বে যখন বিভিন্ন বিপ্লব ঘটে গেছে যেমন নবজাগরন, শিল্প বিপ্লব, সবুজ বিপ্লব প্রভৃতি, তখন আমাদের এখানে বিজ্ঞানের প্রবেশ। সারা বিশ্বে যখন বিভিন্ন বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটছিল তখন ইয়ং বেঙ্গল এই পরিবর্তনকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের যোগসুত্র বহু পুরনো। যদি বৈষ্ণব পদাবলী ধরা হয়, তাহলে চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বিদ্যাপতি প্রভৃতি নামগুলি তার উদাহরণ। কীর্তন, বাউল, সংগীত প্রভৃতি মানব সাহিত্যে অসাধারণ উদাহরণের পরিচয়। আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বাঙালির অবদান বেশি না থাকার জন্যই সংস্কৃতিতে আমরা বিজ্ঞানকে সহজে পাইনি। এর পরিবর্তন ঘটে ১৮৭৬ সালে। কলকাতায় সেই সময় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কাল্টিভেশন সাইন্স প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম ভূমিকা ছিল Fr. Eugune Lafont ও ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের। এরপর ১৯০৯ সালে “ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স”-এর প্রতিষ্ঠা হয় ব্যাঙ্গালোরে। তার পিছনে জে এন টাটা ও স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা ছিল। ১৯১৮ সালে বোস ইনস্টিটিউট তৈরি হয়। তার মূল অবদান জগদীশ চন্দ্র বসু কিন্তু ভগিনী নিবেদিতার অবদানও কোনও অংশে কম ছিল না। এখানেই অন্যতম মূল বিন্দু যে এই বিজ্ঞানের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার পিছনে যে সমস্ত মানুষ গুলির ভূমিকা রয়েছে, তার মধ্যে একজন ক্যাথলিক প্রিস্ট, একজন সন্ন্যাসী ও আরেকজন সন্ন্যাসিনী অর্থাৎ আমাদের দেশে যখন বিজ্ঞানের সূচনা হয় তখন সেই সূচনালগ্নে যদি দেখা যায় তাহলে সাংস্কৃতিক যোগসুত্র পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে মহেন্দ্রলাল সরকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সেই সময়ে বিজ্ঞান চর্চাকে আধুনিক সভ্যতায় পৌঁছেছেন আমাদের বিদ্বজ্জনেরা। তারা বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে একমত পোষণ না করলেও বিজ্ঞানকে আমাদের সমাজে যুক্ত করার ব্যাপারে তারা সকলে সহমত ছিলেন। তারা অনুভব করেছিল যে সভ্যতা যদি সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে বিজ্ঞান ছাড়া যে সংস্কৃতি হবে না এটাই ছিল তখনকার কথা ও তখনকার চিন্তা। সুতরাং ওই সময়ে বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিকে একভাবেই দেখা হয়েছিল এবং এই যে শুরুটা হয়েছিল সেটা প্রায় পঞ্চাশ বছর চলেছিল। বিজ্ঞানই একজন মানুষকে সংস্কৃতিবান হতে সাহায্য করে। তখন আমাদের সমাজে সংস্কৃতির পরিচয়ের মধ্যে বিজ্ঞান অঙ্গাঙ্গিকভাবে ভাবে যুক্ত ছিল।

এটা আশ্চর্যের যে বাংলায় যখন উচ্চশিক্ষা নিয়ে পরীক্ষানিরিক্ষা হচ্ছিল, তার ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী এবং আশুতোষ মুখার্জীর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে একটা ব্যাপার যে আশুতোষ মুখার্জীকে নিয়ে বিশদে আলোচনা হয় না। তবে তিনি যেটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে তিনি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নতুন একটা ভীত তৈরি করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আগে শুধু পরীক্ষা নেওয়া হত । লাহোর থেকে ব্রহ্মদেশ (এখন মায়ানমার) থেকে পেশোয়ার থেকে শুরু করে এই সমস্ত জায়গাটায় একটাই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, আর সেটা হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এত বড় অঞ্চলভুক্ত হওয়ায় সেখানে শুধুমাত্র পরীক্ষা নেওয়া হত। এর বাইরে কিছু করা হত না। কিন্তু আশুতোষ মুখার্জী সেখানে গবেষণা আনেন, শিক্ষার সেই গবেষণার মধ্যে সংস্কৃতি ছিল, পালি ভাষা ছিল, ইসলামিক স্টাডিজ ছিল এবং তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অংক ছিল, পদার্থবিদ্যা ছিল, বিজ্ঞান ছিল এবং সে সময়ে চিন্তা করা হয়েছিল যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের সংস্কৃতিকে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে প্রগতি হবে। বিজ্ঞান ছাড়া যে সেই প্রগতি হবেনা এটা তিনি ভালই বুঝেছিলেন। মেঘনাথ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সিভি রমন প্রমূখ ব্যক্তিত্বের সময় সংস্কৃতির সাথে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটে। সেই সময়ে মেঘনাথ সাহা একটি পত্রিকা চালু করেছিলেন যা এখনও চলছে। তার নাম হচ্ছে “সাইন্স এন্ড কালচার”। আগে বিজ্ঞানকে আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ধরার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আমাদের কবিতা-গান, শাস্ত্রীয় সংগীত প্রভৃতি যেগুলি চলে এসেছিল যা আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীকভাবে যুক্ত ছিল, সেখানে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ছিল না। সে সময়ে বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের সেরকম কিছু ভাবারও ছিলনা। গ্রহণের সময় রাহু কেতু তারা কি সূর্যকে গ্রাস করে না চন্দ্রকে গ্রাস করে এবং সেটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা এই নিয়ে কোনও মানুষের খুব বেশি চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু একবার সেটা জানতে পারার পরে সেখান থেকে মানুষ আরও নতুন নতুন তথ্য জানতে পারেন। আমাদের সময়ে আমরা যখন স্কুলে পড়ি জহরলাল নেহেরুর আমলে, সেই সময় আমরা যারা ভাল রেজাল্ট করতে পারতাম তাদের রেজাল্টে একটি স্ট্যাম্প মেরে দাওয়া হত এবং সেখানে সাইন্স লেখা থাকত। ফলে আমাদের বোঝানো হতো যে আমাদের সাইন্স ছাড়া কোনও গতি নেই। সেই সময়েই আইআইটি তৈরি হচ্ছে, সেই সময় আমাদের উচ্চ শিক্ষার প্রচার ও প্রসার হয়েছিল যেখানে সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধন ছিল। কিন্তু আজ বিজ্ঞানের সৌন্দর্য কি, সেটা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে সংস্কিৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ, বিজ্ঞান-সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। ফলে আমাদের সংস্কৃতি কতটা বিজ্ঞান বিমুখ হয়েগেছে, সেই দূরত্ব কমাতে হবে। মানুষকে আরোও সচেতন করতে হবে।

সৌজন্য: বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড