বিশ্ববীণারবে/ পর্ব ২

বিশ্ববীণারবে/ পর্ব ২

রাতের আকাশ ও ওলবার্সের ধাঁধা

যে রাতে আকাশে চাঁদ ওঠে না, থাকে শুধু জ্যোৎস্নার আবছা মিহি আলো; সে সময় গ্রামের দিকে চারদিক খোলা কোনও মাঠের মাঝখানে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে আমাদের কারও না কারও হয়তো অনে এই প্রশ্ন জাগে, অজস্র বিন্দু বিন্দু তারায় ভরা আকাশ কালো কেন?

আকাশ পুরোপুরি পরিষ্কার থাকলে, খালি চোখে পুরো আকাশ জুড়ে আমরা কম বেশি দু’হাজারের মতো নক্ষত্র দেখতে পাই। কিন্তু আকাশে তো তারার সংখ্যা এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি, বলা যায় প্রায় অসংখ্য। আর মহাকাশকে যদি আমরা সবদিকে অসীমভাবে বিস্তৃত ধরে নিই, তবে ওই অসীম এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়ে থাকা মহাকাশে অসীম সংখ্যক তারার কোনও না কোনওটিকে তো আকাশের গায়ে কোনও না কোনও বিন্দুতে দেখতে পাওয়া উচিত, তাই না? আর সেটা সত্যি হলে আকাশকেও তো আর কালো দেখা উচিত না, বরং আশা করা উচিত যে রাতের বেলাতেও পুরো আকাশকেই উজ্জ্বল লাগবে। কিন্তু বাস্তবে তো তা হয় না!

ছবি। ওলবার্স প্যারাডক্স। বাঁ দিকের ছবিতে নীল গোলটা কোনও মানুষের দৃষ্টিপথ। যদি আকাশে অসীম সংখ্যক তারা আছে বলে ধরে নিই, তাহলে ওই নীল দাগ থেকে যে দিকেই সরলরেখা টানা হোক, কোনও না কোনও তারার গায়ে লাগবে। আর সেটা সত্যি হলে আকাশের প্রত্যেক বিন্দুতেই একটা না একটা তারা নজরে আসা উচিত, আর সেক্ষেত্রে আকাশকে মোটেই কালো দেখানোর কথা না, দিনের বেলার মতোই সাদা উজ্জ্বল দেখানো উচিত!

এই প্রশ্ন জেগেছিল দুশো বছর আগে ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান হেইনরিখ উইলহেল্ম ম্যাথিয়াস ওলবার্স (১৭৫৮-১৮৪০) নামে এক বিজ্ঞানীর মনেও। তিনিই এই ধাঁধা বা paradox-টি (প্যারাডক্সের ভালো একটা বাংলা আছে— ‘কূটাভাস’) তৈরি করেন, তাঁর নামেই এই প্রশ্ন ‘ওলবার্স প্যারাডক্স’ নামে পরিচিত। রাতের আকাশ কালো কেন? এটাই ছিল মূল সমস্যা। যদিও তাঁর অনেক বছর আগে ১৫৭৬ সালে থমাস ডিগস নামের এক বিজ্ঞানীও একই কথা ভেবেছিলেন, উত্তর পাননি যদিও। ওলবার্স নিজে এই ব্যাপারটাকে সমাধান করলেন এই যুক্তি দেখিয়ে— দূরের তারা থেকে যে আলো আসে, তা আসার পথে তারাদের মধ্যবর্তী জায়গায় যে সব গ্যাসীয় বা ধুলোজাতীয় কণা-পদার্থ থাকে সেগুলির মধ্যে শোষিত হয়ে যায়, ফলে সেই আলো আর আমাদের চোখে আসে না। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠে, তাই যদি হত, তবে সেই পদার্থ তো তারাদের আলো আর তাপ শোষণ করে উত্তপ্তও হত, এবং যতক্ষণ না তার উত্তাপ ওই তারাটির মত হচ্ছে, ততক্ষণ তাপ নিয়েই যেত। আর তার পর সে ওই তাপ আবার বিকিরণ করতে শুরু করে দিত, এবং ফলে সেই মধ্যবর্তী মাধ্যমটিও তারাটির মতো আলো ছড়িয়েই যেত। পুরো আকাশ যেমন আলোকিত দেখানোর কথা, তেমনিই দেখাত।

ছবি। হেইনরিখ ওলবার্স। রুডলফ শুরল্যান্ট-এর আঁকা।

ওলবার্স নিজে নিজেরই দেওয়া সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হলেও পরে বিজ্ঞানীরা এর একটা সমাধান  করেছেন। এই ধাঁধার সমাধান করা যায় যদি আমরা ধরে নিই মহাবিশ্ব অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত নয়, অর্থাৎ তার সীমানা রয়েছে। আর মহাবিশ্ব অসীম কাল থেকে আজ পর্যন্ত টিকে আছে, এমনটাও নয়। কোনও একটা সময়ে, সে অনেক অনেক কাল আগে হতে পারে, কিন্তু একটা সময়ে যে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল, এইটা ধরে নিতেই হবে আমাদের।

আর আমরা যে নক্ষত্রদের আকাশে দেখছি, তারাও যে অনন্তকাল ধরে আকাশে হাজিরা দিচ্ছে এমনটাও নয়। আলোর বেগ যে অসীম নয়, আর সেই জন্যে আমরা যে সূর্যকে দেখি, সেটাকে যে মুহূর্তে আমরা দেখছি তা হল আট মিনিট কুড়ি সেকেন্ড আগের সূর্য, কারণ সূর্য থেকে আমাদের এখানে আলো আসতে ওইটুকুই সময় লাগে। সুতরাং ওই একই যুক্তিতে আকাশে অন্য যে সব নক্ষত্রদের আমরা দেখি, সেগুলি সবাই বহু লক্ষ বছর বা তারও আগেকার, আমরা সেগুলোর সেই সময়কার চেহারা দেখছি। আর এখন সেগুলির কী অবস্থা, তা জানতে আমাদের আরও বহু লক্ষ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আবার এমনও অনেক তারা আকাশে আছে, যেগুলি এত দূরে আছে যে সেগুলির আলো এখনও আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়নি। অর্থাৎ তারা আমাদের দৃষ্টিপথের বাইরে রয়ে গেছে এখনও।

এমন একটা ন্যূনতম দূরত্ব আছে, যে দূরত্বের চেয়ে দূরে থাকা তারার আলো এখনও আমাদের চোখে এসে পড়েনি, সেই দূরত্বকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘দিগন্ত দূরত্ব’, বা Horizon distance। সুতরাং সিদ্ধান্ত হল এই যে আমরা আকাশের গায়ে কোনও একটা বিন্দুর দিকে তাকালেই যে কোনও না কোনও তারাকে দেখতে পাচ্ছি না, সেটা এই মহাবিশ্বের সসীমতার কারণে। যে স্থানিক বিন্দুগুলিকে আমরা অন্ধকার দেখছি, হতেই পারে সেখানে বহু কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে রয়েছে এমন কোনও নক্ষত্র, যার আলো অনেক দিন আগে সবদিকে যাত্রা করেছে, এখনও এসে পৌঁছয়নি আমাদের চোখে।

ছবি। এডগার অ্যালান পো। সম্ভবত জুন ১৮৪৯-এ দাগেরোটাইপ পদ্ধতিতে তোলা ছবি। চিত্রগ্রাহক অজ্ঞাত।

সবচেয়ে মজার এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই ধাঁধা প্রথমবার সমাধান করেছিলেন কোনও বিজ্ঞানী নয়, করেছিলেন একজন সাহিত্যিক, যাঁর নাম এডগার অ্যালান পো। তাঁর মৃত্যুর বছরখানেক আগে ১৮৪৮ সালে লেখা ‘Eureka: an essay on the material and spiritual universe’ নামে একটি গদ্যে তিনি স্পষ্টই বলেন, এই মহাবিশ্ব মোটেই অসীম নয়। আর এর বয়সও অসীম নয়। আমরা এই মহাবিশ্বের খুব অল্প কিছুটা দেখতে পাই, তাই সেই দৃশ্যমান সীমানার মধ্যে যে তারারা রয়েছে, সেগুলো থেকেই আলো এসে আমাদের চোখে পৌঁছয়, আর তাই আকাশের সবদিকে তারাদের দেখা না যাওয়ার কারণেই আকাশ পুরোপুরি আলোকিত হয় না।

(ক্রমশ)