অতল সাগরে অজানা প্রাণ

অতল সাগরে অজানা প্রাণ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে, যেখানে সূর্যালোক পৌঁছায় না, খাদ্য প্রায় নেই, আর সময় যেন চলে ধীরগতিতে —সেই গভীর সমুদ্রতলেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন জীববৈচিত্র্যের এক অবাক করা ভাণ্ডার। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় মেক্সিকো আর হাওয়াইয়ের মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ৪,০০০ মিটার গভীরে প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ল্যারিওন-ক্লিপারটন জোনে (সি সি জেড) শনাক্ত হয়েছে ৭৮৮টি প্রাণী প্রজাতি, যার বেশিরভাগই আগে বিজ্ঞানের কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল।

এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশান জার্নালে। মূলত গভীর সমুদ্রের খনিজ সম্পদ আহরণ নিয়ে ব্যাপক বৈশ্বিক আগ্রহই এমন বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার সুযোগ তৈরি করেছে। বৈদ্যুতিক যান, নবায়নযোগ্য শক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাতু এই অঞ্চলের সমুদ্রতলেই মজুত আছে। কিন্তু সেগুলি উত্তোলন করলে প্রকৃতির কী ক্ষতি হতে পারে, সেই ধারণা এতদিন স্পষ্ট ছিল না।

গবেষণার ফলাফল একদিকে বিস্ময়কর, অন্যদিকে সতর্কতামূলক। যেসব এলাকায় পরীক্ষামূলক খনন চালানো হয়েছে সেখানে দেখা গেছে, প্রাণীর মোট সংখ্যা প্রায় ৩৭ শতাংশ কমে গেছে, আর প্রজাতি বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ, গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে খননের প্রভাব স্থানীয়ভাবে গভীর ও সুস্পষ্ট। যদিও গবেষকরা মনে করেন, এই ক্ষতি সমগ্র সমুদ্রতলে সমানভাবে ছড়ায় না এবং পূর্বের আশঙ্কার চেয়ে সামগ্রিক প্রভাব কিছুটা সীমিত হতে পারে।

পাঁচ বছর ব্যাপী এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সমুদ্রে কাটিয়েছেন প্রায় ১৬০ দিন। তাঁরা আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ (আই এস এ)–এর নির্দেশিকা মেনে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করেন। সংগৃহীত নমুনায় প্রধানত পাওয়া গেছে সামুদ্রিক ব্রিসল কৃমি (পলিচেট কৃমি ), বিভিন্ন ক্রাস্টেশিয়ান এবং শামুক–ঝিনুক জাতীয় মোলাস্ক প্রাণী। পাশাপাশি আবিষ্কৃত হয়েছে এক নতুন প্রজাতির একাকী প্রবাল—ডেল্টোসায়াথাস জোয়েমেটালিকাস —যা ধাতব নডিউলের( ছোটো গোলাকার গুটি) সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেঁচে থাকে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এই বিপুল জীববৈচিত্র্যের ভৌগোলিক বিস্তার সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এখনও অত্যন্ত সীমিত। এমনকি সি সি জেড –এর প্রায় ৩০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকায় কী ধরনের প্রাণ বাস করে, তা নিয়েও নিশ্চিত তথ্য নেই। গবেষকদের মতে, গভীর সমুদ্র খননের অনুমতি দেওয়ার আগে এই অজানা অঞ্চলগুলোর জীববৈচিত্র্য আগে বোঝা দরকার। গবেষণাটি আমাদের সামনে এক দ্বৈত বাস্তবতা তুলে ধরেছে। একদিকে টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের খোঁজ, অন্যদিকে সেই ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য প্রকৃতির অদৃশ্য অথচ অমূল্য জগতকে রক্ষা করার দায়িত্ব।

 

সূত্র: “Impacts of an industrial deep-sea mining trial on macrofaunal biodiversity” by Eva C. D. Stewart, Helena Wiklund, et.al; 5th December 2025, Nature Ecology & Evolution.

DOI: 10.1038/s41559-025-02911-4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × five =