অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম কুমির জীবাশ্ম

অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম কুমির জীবাশ্ম

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব কুইন্সল্যান্ডের ছোট্ট শহর মার্গনে এক সাধারণ কৃষকের উঠোনে প্রায় দশক খানেক ধরে খনন চালিয়ে আসছেন গবেষকেরা। বাইরে থেকে দেখতে সাদামাটা এই কাদায় ভরা গর্ত আসলে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম প্রাচীন জীবাশ্ম ভান্ডার। এখানেই মিলেছে দেশের সবচেয়ে পুরোনো কুমিরের ডিমের খোসা। যা আন্দাজ ৫৫ মিলিয়ন বছরেরও বেশি প্রাচীন। যখন অ্যান্টার্কটিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেই সময়কারই জীবনের সরাসরি সাক্ষ্য এটি।

আন্তর্জাতিক গবেষকদলের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় ইউ এন এস ডাব্লিউ সিডনির বিজ্ঞানীরাও যুক্ত ছিলেন। তাঁরা যে ডিমের খোসার ক্ষুদ্র খণ্ডাংশ শনাক্ত করেছেন, তার নাম দেওয়া হয়েছে ওয়াক্কাওলিথাস গডথেল্পি । এদের মালিক ছিল বিলুপ্ত মেকোসুচিন কুমির—একসময়ের অস্ট্রেলিয়ার জলাভূমির প্রকৃত শাসক। আজকের লোনা ও মিঠা জলের কুমিরেরা এই মহাদেশে এসেছে মাত্র ৩.৮ মিলিয়ন বছর আগে।

গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জেভিয়ার পানাডেস আই ব্লাস বলেন, “এই ডিমের খোসাগুলি আমাদের মেকোসুচিনদের অন্তরঙ্গ জীবনের ইতিহাসের এক ঝলক দিয়েছে।“ তাদের মতে, এই ডিমের খোসা শুধু কুমিরগুলোর শারীরিক গঠন নয়, তাদের প্রজনন কৌশল এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজন সম্পর্কেও নতুন ধারণা দিচ্ছে। মেকোসুচিনরা কেবল জলের প্রাণী ছিল না—কিছু প্রজাতি ছিল স্থলজ শিকারি, আবার কেউ কেউ গাছে চড়ে লুকিয়ে শিকার ধরত। উত্তর–পশ্চিম কুইন্সল্যান্ডের রিভারস্লি অঞ্চলের ২৫ মিলিয়ন বছরের পুরোনো জীবাশ্মে এমন ‘ড্রপ ক্রোক’ -এর প্রমাণ মেলে, যারা নাকি গাছের ডালে বসে শিকারকে উপর থেকে ঝাঁপিয়ে আক্রমণ করত।

মার্গনের ডিমের খোসাগুলোকে অপটিক্যাল ও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে—মেকোসুচিন কুমিরেরা হ্রদের ধার ঘেঁষে ঘর বাঁধত এবং ডিম পাড়তো । তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের বাসস্থান ধীরে ধীরে তছনছ হতে থাকে। শুষ্ক অঞ্চল বাড়তে থাকায় তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল ছোট ও সংকীর্ণ জলপথের দিকে, যেখানে নতুন কুমির প্রজাতির আগমন ও শিকার কমে যাওয়ার কারণে অস্তিত্ব রক্ষার প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠেছিল।

মার্গনের এই হ্রদ–অববাহিকাকে ঘিরে ছিল এক সমৃদ্ধ বনভূমি। এখানে মিলেছে বিশ্বের প্রাচীনতম সুরেলা পাখি, অস্ট্রেলিয়ার প্রাথমিক ব্যাঙ–সাপ, দক্ষিণ আমেরিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী এবং প্রাচীন বাদুড় প্রজাতির চিহ্ন। ফলে এই আবিষ্কার শুধু একটি কুমির প্রজাতির নয়, বরং গোটা একটি প্রাচীন বাস্তুতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরছে। মার্গনের টিংগামাররা জীবাশ্মভাণ্ডারে দীর্ঘদিন খনন করা বিজ্ঞানীরা মনে করেন—এখানে এখনো বহু চমক চাপা আছে। গবেষণার অগ্রদূত প্রফেসর মাইকেল আর্চার স্মরণ করেন, ১৯৮৩ সালে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুমতি নিয়ে প্রথমবারের মতো এই উঠোনে খনন শুরু করেছিলেন তারা। তারপর থেকে এখানে প্রতি পদে মিলেছে নতুন চমক—এবারের ডিমের খোসা তারই ধারাবাহিকতা।

গবেষকদের মতে, এই আবিষ্কার অতীতের ইতিহাসকে আলোকিত করার পাশাপাশি সংরক্ষণবিদদেরও পথ দেখায়। যেমন প্রফেসর আর্চারের ‘বুরামিজ প্রকল্প’ দেখিয়েছে— জীবাশ্ম রেকর্ড বুঝে সঠিক পরিবেশে ফিরিয়ে দিলে বিপন্ন প্রজাতি আবারও বেঁচে উঠতে পারে। হতেও তো পারে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির যুগে এই বার্তাই অতীতের সন্ধান সূত্র যা হয়তো অনেক প্রাণের ভবিষ্যৎকে বাঁচাতে পারে।

 

সূত্র: “Australia’s oldest crocodylian eggshell: insights into the reproductive paleoecology of mekosuchines” by Àngel Galobart, Michael Archer, et.al; 11th November 2025, Journal of Vertebrate Paleontology.

DOI:10.1080/02724634.2025.2560010

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × four =