আদিমকালের মত আজও একইরকম অপরিহার্য আগুন

আদিমকালের মত আজও একইরকম অপরিহার্য আগুন

সুদীপ পাকড়াশি
Posted on ২৩ অক্টোবর, ২০২১

আগুন মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই নিয়ে স্টিফেন পাইন লিখেছেন একটি জনপ্রিয় বই। নাম পাইরোসিন। পাইনের সারাজীবনের একাধিক গবেষণার মধ্যে আগুনের ভূমিকা অন্যতম। তাকে আগুন নিয়ে পৃথিবীর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একজন ধরা হয়। মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে যুগে যুগে কীভাবে মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছে, মানুষ কীভাবে আগুনের অপব্যবহারে নিজেকেই ধ্বংস করেছে সেই নিয়েই পাইনের এত বছরের গবেষণা, পাইরোসিন বইটার সৃষ্টি।
আগুনের ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে পাইন একে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। তার প্রথম পর্যায় ‘প্রথম-আগুনের ইতিহাস’। পাইনের মতে আগুনের প্রথম ইতিহাস প্রকৃতিরই দান। পাইন জানিয়েছেন, বজ্র ও বিদ্যুতের ঝলকানিতে অজস্র উদ্ভিদ পুড়ে নষ্ট হয়ে যেত। শুধু উদ্ভিদ নয়, উদ্ভিদের বীজের ধ্বংসও বিদ্যুতের আগুনে পুড়ে যেত। পাইনের মতে আগুন বায়োমাস পচিয়ে দেয় কিন্ত একইসঙ্গে পচে যাওয়া উদ্ভিদের মধ্যে সৃষ্টি করে এবং একত্রিত করে দেয় সালোকসংশ্লেষকে। পাইনের মতে এভাবেই আগুন আবার উদ্ভিদকূলের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে!
পাইনের মতে আগুনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘ইতিহাস’ তৈরি করেছে মানুষ নিজেই। ২০ লক্ষ বছর আগে। আদিম মানুষ যেসময়ে পরিবেশ থেকে আগুন নিয়ে তাকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করত। পাইন জানিয়েছেন, আগুন ছিল সেই সময়ের মানুষের কাছে একটি ‘গেম চেঞ্জার’! আগুন ছিল সেই সময়ের মানুষের কাছে বিভিন্নরকমের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম (মূলত পুড়িয়ে খাওয়ার কাজে) এবং অস্ত্রও। আগুনের সেই ব্যাবহার আদিম মানুষ তাদের উত্তরসূরীদেরও শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে। রান্না শব্দটার সঙ্গে আদিম মানুষের যে পরিচয় হয়েছিল তার অন্যতম মাধ্যম ছিল আগুন। শুধু রান্না করতে পারা নয়, প্রচুর অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদের বীজ আগুনে পুড়িয়ে দিত সেই সময়ের মানুষ। যাতে আবার সতেজ উদ্ভিদের বীজ জন্মায়। একইসঙ্গে আগুনের সহায়তায় আদিম মানুষ এবং তাদের উত্তরসূরীরা তৈরি করতে শিখেছিল একাধিক প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং শিকারের অস্ত্র। পাইন জানিয়েছেন, আগুনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ইতিহাসে আদিমকালে মানবসভ্যতা মূলত পরিবেশের সহায়তায় যেভাবে আগুনকে ব্যবহার করেছে সেটা ইচ্ছাকৃত হলেও তার মধ্যে ভারসাম্য ছিল।
কিন্তু পাইনের তৃতীয় পর্যায়ের আগুনের ইতিহাসে ক্রমশ উধাও সেই ভারসাম্য! আগুনকে জ্বালাতে মানুষ আবিষ্কার করেছে উন্নতধরনের যন্ত্র। তাতে জ্বালানির তীব্রতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। আগুন নিয়ে উদ্ভাবনী ক্ষমতায় মাটির নীচ থেকে মানুষ কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের মত খনিজদ্রব্য বার করে একের পর এক উন্নয়নের যুগান্তকারী পথ সৃষ্টি করেছে। আগুনকে প্রযুক্তির আধুনিকতায় ব্যবহার করে মানুষ সৃষ্টি করেছে বিশাল এক বিস্তৃতির।
কিন্তু তার ফল কী পেয়েছে মানুষ? পাইন জানাচ্ছেন, বর্জ্য এক বায়ুমণ্ডল! যার প্রতিফলনে বিশ্ব উষ্ণায়ন। পাইন আরও জানিয়েছেন, শুধু বায়ুমণ্ডল নয়, দাবানলের করাল থাবায় পৃথিবীর প্রচুর দেশ আজ বিপর্যস্ত। যেমন আমেরিকা, যেমন অস্ট্রেলিয়া।
শেষপর্যন্ত, আগুন নিয়ে পাইন শুনিয়েছেন আশার কথাও! বলেছেন, “আগুনকে আমাদের দেখা উচিত সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে। আগুনের সহায়তায় আমরা পরিচিত হয়েছিলাম পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যার সঙ্গে। কিন্তু যেদিন মানসভ্যতা আগুনকে বশ করে মেশিনের অন্তর্ভূক্ত করে ফেলেছিল তখন থেকে মানুষ ভুলে গিয়েছিল যে, আগুন মানবসভ্যতার ইতিহাসে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের উন্নত মানুষ ভুলে গিয়েছিল আদিম মানুষ থেকে আধুনিক মানষের বিবর্তনে আগুনের কী ভূমিকা ছিল। অথচ আজও কিন্তু সেই আগুনের সহায়তাতেই মানবসভ্যতা মহাকাশের দিকে হাত বাড়িয়েছে! গ্রহ এবং তাদের চারপাশকে ভৌগলিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং ইন্টেলেকচুয়ালি সংহত করার কাজে আগুনের নিঃশব্দ ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে পড়ছে।”
পাইন বলতে চেয়েছেন আগুন ছাড়া আজও মানুষের বাঁচার উপায় নেই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 × 3 =