আর্সেনিক-মুক্ত জলপানের উপযোগিতা  

আর্সেনিক-মুক্ত জলপানের উপযোগিতা  

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশে দীর্ঘ দুই দশক ধরে পরিচালিত এক জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত গবেষণার অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, পানীয় জলে আর্সেনিকের মাত্রা কমাতে পারলে ক্যানসার, হৃদরোগসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় মৃত্যুর হার অর্ধেক পর্যন্ত কমে যায়। প্রায় ১১,০০০ প্রাপ্তবয়স্ককে নিয়ে পরিচালিত এই গবেষণার ফল JAMA–তে প্রকাশিত হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত আর্সেনিক কমানোর স্বাস্থ্য–প্রভাব নিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

দেখা গেছে, যারা বহু বছর উচ্চমাত্রার আর্সেনিকযুক্ত জল পান করলেও পরে নিরাপদ নলকূপের জল খেয়েছেন , তাদের মৃত্যুঝুঁকি নেমে এসেছে সেই স্তরে যাদের জীবনভরই আর্সেনিকের ক্ষতিকারক প্রভাব কম ছিল। অর্থাৎ, অতীতের ক্ষতিকর প্রভাব স্থায়ী নয়; পরিষ্কার জল শরীরকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেয়।

গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। প্রাকৃতিক আর্সেনিক দূষণ এখনো বিশ্বের বহু অঞ্চলের জলসম্পদকে হুমকির মুখে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১০ কোটিরও বেশি মানুষ ভূগর্ভস্থ জল থেকে সম্ভাব্য আর্সেনিকের ঝুঁকিতে । তবে বাংলাদেশে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ—প্রায় ৫ কোটি মানুষ বছরের পর বছর WHO–এর নিরাপদ মাত্রার বহু গুণ বেশি আর্সেনিক যুক্ত জল পান করেছেন। তাই WHO এই অবস্থাকে ইতিহাসের “সবচেয়ে বড় গণ-বিষক্রিয়া” বলেছে।

HEALS নামে পরিচিত এই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে ২০০০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার অঞ্চলের ১০,০০০–এর বেশি কূপ পরীক্ষা করে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের প্রস্রাবে আর্সেনিক মাপা হয় নিয়মিত, যার ফলে কার শরীরে আর্সেনিকের মাত্রা কত বেশি প্রভাব ফেলেছ —তা অত্যন্ত নির্ভুলভাবে জানা গেছে। পাশাপাশি এই অঞ্চলগুলোর মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে—যারা উচ্চ আর্সেনিক থাকা জলের নলকূপ ছেড়ে নিরাপদ কুয়োর জল খেয়েছেন, তাদের মৃত্যুঝুঁকি দ্রুত কমেছে। অন্যদিকে যারা দূষিত জেনেও সেই নলকূপের জলই খেয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার একই রকম উচ্চ রয়ে গেছে।

এ সময় সরকার ও এনজিওরা নলকূপে লাল- সবুজ রঙিন চিহ্ন দিয়ে নিরাপদ–অনিরাপদ আলাদা করে দেয়,গভীর নলকূপ বসানো হয় এবং অনেক পরিবার স্বেচ্ছায় নিরাপদ উৎসের জল পান করতে শুরু করেন। এর ফলে অঞ্চল জুড়ে ব্যবহৃত নলকূপগুলোর আর্সেনিকের মাত্রা কমে প্রায় ৭০ শতাংশ। অংশগ্রহণকারীদের দেহের আর্সেনিকও অর্ধেকে নেমে আসে এবং বহু বছর ধরে তা স্থিতিশীল থাকে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রতিদিনের জলের উৎস বদলানোই স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর মুখ্য চাবিকাঠি। গবেষকেরা বলছেন, আর্সেনিক কমানোর স্বাস্থ্য–ফল লাভ অনেকটা ধূমপান ছাড়ার মতো। ঝুঁকি সঙ্গে সঙ্গে না কমলেও বছর বছর ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কমতে থাকে।

 

বাংলাদেশে ইতিমধ্যে নলকূপ পরীক্ষা, গভীর নলকূপ স্থাপন ও নিরাপদ কূপের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গবেষকদের তৈরি ‘নলকূপ’ নামের একটি অ্যাপ এখন লাখো কূপের উপাত্ত দেখিয়ে জনগণকে নিরাপদ উৎস বেছে নিতে সহায়তা করছে।

সব মিলিয়ে এই গবেষণা একটি জোরালো বার্তা দেয়—পরিষ্কার জলের জন্য অব্যাহত বিনিয়োগ কেবল রোগ প্রতিরোধ নয়, পুরো এক প্রজন্মের জীবন বাঁচাতে পারে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এখন আর্সেনিক–প্রবণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্য কার্যকর দিকনির্দেশনা হয়ে উঠছে।

 

সূত্র: Twenty-year study shows cleaner water slashes cancer and heart disease deaths Materials provided by Columbia University’s Mailman School of Public Health, 27th November,2025.

DOI: 10.1001/jama.2025.19161

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 3 =