
এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহ অধ্যাপক শশাঙ্ক শেখরের পরিচালনায় একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে বহুকোষী জীবদের বিবর্তনের পিছনে রয়েছে সমবায়ী আহারগ্রহণের ফ্লুইড গতিশীলতার প্রক্রিয়া। স্টেন্টর নামে শিঙা আকৃতির বিরাট এককোষী জীবের আহারগ্রহণের আচরণ লক্ষ্য করে তাঁর মাথায় এই ভাবনাটা আসে। তরলের মধ্য দিয়ে তারা যেভাবে চলাফেরা করে সেটা অনুসন্ধান করলে হয়তো এককোষী জীবন থেকে জটিল জীবনে উত্তরণের সূত্র মিলতে পারে, এই ধারণা থেকে তিনি গবেষণা শুরু করেন। তরলপ্রবাহের সুন্দর সুন্দর চিত্র নিয়ে এই প্রকল্পের সূচনা। ওই আচরণের বিবর্তনী তাৎপর্যের ব্যাপারটা পরে বোঝা যায়। মিষ্টি জলের পুকুরের উপরিতলের কাছাকাছি স্টেন্টরদের খালি চোখেই ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। বাড়তে বাড়তে তারা দুই মিলিমিটার দৈর্ঘ্য অর্জন করে। জলে ভাসমান গাছের পাতা, ডাল কিংবা অন্য কিছুকে আঁকড়ে ধরবার জন্য তারা শরীরের এক প্রান্ত থেকে আঠালো একরকম রস বার করে। আর অন্য প্রান্তটি খানিকটা চওড়া আর খোলামুখ। সে-প্রান্তটিকে ঘিরে-থাকা সরু সরু চুলের মতো ‘সিলিয়া’ বিশেষ ছন্দে কাঁপতে থাকে, ফলে তৈরি হয় জলস্রোত। আর সেই সঙ্গেই সিলিয়া খাদ্যকণা টেনে নেয়। অণুবীক্ষণ ভিডিও দিয়ে শেখর একটিমাত্র স্টেন্ট কীভাবে খাদ্য গ্রহণ করে তার ছবি তোলেন। দেখা যায় সেটি মুখের মধ্যে একসঙ্গে দুটি ঘূর্ণি (ভর্টিস) তৈরি করে ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল প্রভৃতি খাদ্যকে টেনে নেয়। তরলের এই গতিবিধি যাতে চোখে দেখা যায়, সেজন্য তিনি খুব ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের পুতি তরলের মধ্যে ভাসিয়ে দেন। সেগুলি থেকে জলস্রোতের অভিমুখটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। একলা একলা আহার গ্রহণের সময় এই সিলিয়ার তৈরি করা স্রোত যে কত কার্যকর তা বোঝা যায় এই পরীক্ষা থেকে। কিন্তু শেখর লক্ষ্য করেন, স্টেন্টরা মাঝে মাঝে দল বাঁধে, কখনো দুজনের জুটি গড়ে, কখনো-বা অনেকে মিলে অর্ধৃত্তাকারে সাজানো বসতি গড়ে তোলে। এই দলগুলোর আহার গ্রহণের আচরণ রেকর্ড করার সময় তিনি একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেন। তিনি বলেছেন, “ এ যেন গানের কলি: “ভালোবাসি, ভালোবাসি না”। কারণ, স্টেন্টর-জুটিগুলো পরস্পরের দিকে ভেসে আসে আবার দূরে সরে যায়। দুটি স্টেন্টরের মাথা যখন কাছাকাছি আসে তখন তখন তরলের দুটি প্রবাহ মিলে একটি জোরালো ঘূর্ণি (ভর্টেক্স) তৈরি করে, যা অনেক বেশি জায়গা থেকে খাবার টেনে নেয়। বড়ো বড়ো দল গঠন করলে খাদ্যগ্রহণের এই সুবিধা বাড়ে। একলা জীব কিংবা দুটি জীবের জুটির তুলনায় অনেক স্টেন্টরদের নিয়ে গঠিত বসতিগুলি অনেক দূর থেকে আরও বেশি খাবার টেনে আনতে পারে। এইটা দেখার পর প্রশ্ন উঠল: সমবায়ই যদি খ্যাদ্যগ্রহণের উন্নতি ঘটায়, তাহলে স্টেন্টররা মাঝে মাঝে দল ছেড়ে চলে যায় কেন? হয়তো সবকটা স্টেন্টর বসতি গড়ার সুবিধা সমানভাবে পায় না। বসতিগুলো গতিশীল, কারণ স্টেন্টররা কেবলই জুড়ি বদলায়। বলা যায়, শক্তিশালী জুড়িগুলো থেকে সুবিধে আদায় করা হয়। তারা ঘনঘন জুড়ি বদলায়, যাতে করে সকলেই সমানভাবে উপকৃত হয়। এ থেকে মনে হল, যেসব স্টেন্টর বেশি শক্তিশালী তারা সাময়িকভাবে দল ছেড়ে যায় যাতে করে দুর্বলতর স্টেন্টরগুলো তাদের কাছ থেকে সুবিধে আদায় করে নিতে না-পারে। ওদিকে, আলাদা হয়ে থাকলেই দুর্বলতর স্টেন্টরগুলোর লাভ বেশি। এইসব ধারণার সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার জন্য গবেষকরা গাণিতিক মডেল বানালেন। এইসব মডেল থেকে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, দুটি জীবের জুটিতে একটি জীব সবসময়েই বেশি সুবিধে পায়। ওদিকে, বৃহত্তর দলগুলি, বিশেষ করে সেইসব দল যাদের সদস্যরা মাঝে মাঝে জায়গা বদলায়, তাদের প্রতিটি সদস্য সব মিলিয়ে গড়পড়তায় বেশি আহার পায়। এ থেকে সাময়িক বসতি স্থাপনের উপযোগিতা কী তার ইঙ্গিত মিলল। বিশেষ করে বেশি খাবার টেনে নেওয়ার সামর্থ্যর ব্যাপারটা। এটাই হয়তো এককোষী থেকে জটিল বহুকোষী জীবনে আদি উত্তরণের পথে একটা ভূমিকা পালন করেছিল। শেখর বলেছেন, “আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, মস্তিষ্ক, এমনকি মস্তিষ্ককোষ ছাড়াই এরা সুবিধা লাভ ও সমবায়ের এই আচরণের বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল। হয়তো বিবর্তনের পথে বহু আগেই এই ধরণের আচরণ জীবদের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। এতটা আগে যে এ ঘটনা ঘটেছিল সেটা আমরা এতদিন বুঝতে পারিনি”। শেখর জানিয়েছেন, “একটা স্টেন্টরকে কুচি কুচি করে কেটে ফেললে প্রত্যেকটা কুচি বারো ঘণ্টার মধ্যে এক একটা আস্ত জীবে পরিণত হবে”। এই গবেষণাপত্রটি ‘নেচার ফিজিক্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
চিত্র স্বীকৃতি: শশাঙ্ক শেখর।