
মানুষ যখন কথা বলে, তখন তার মধ্যে একধরনের স্থিতিশীল ছন্দ কাজ করে। বিশ্বের সব সংস্কৃতিতেই এই বিষয়টি প্রায় এক। হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের গবেষক দল সম্প্রতি জানাচ্ছেন, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে ছোট ছোট বাক্যাংশ বা সুরশব্দ ইউনিট (Intonation Unit, IU) আকারে কথা সাজায়। গড়ে প্রতি ১.৬ সেকেন্ডে সেই বাক্যাংশ একবার উচ্চারিত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এই নিয়ম সব ভাষাতেই ধরা পড়ে। সব বয়সেই ধরা পড়ে- শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ড. মায়া ইনবার, প্রফেসর ইটান গ্রসম্যান ও প্রফেসর আয়েলেট এন. ল্যান্ডাউ। ল্যান্ডাউ একইসঙ্গে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর সঙ্গেও যুক্ত। ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে তারা এই নতুন অনুসন্ধানটি করেছেন। ড. ইনবারের ভাষায়,“ আমাদের কথা বলার ছন্দ কেবল সাংস্কৃতিক অভ্যাস নয়। এটি মানুষের জৈবিক ও জ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যের গভীরেই প্রোথিত।” একটি বাক্যাংশ হল, স্বরভঙ্গি, জোর ও সময়ের সূক্ষ্ম সমন্বয়ে তৈরি এক একটি ছোট ধ্বনি-খণ্ড। প্রতিটি ইউনিটে একটি স্বতন্ত্র তথ্য থাকে। তারপরেই নতুন বাক্যাংশ শুরু হয়। শ্রোতারা এই খণ্ডগুলির ছন্দ ধরে বক্তব্য বোঝেন এবং উত্তর দেওয়ার ‘সময়’ নির্ধারণ করেন। গবেষকরা ২৭টি ভাষা পরিবারের অন্তর্গত ৪৮টি ভাষার ৬৬৮টি রেকর্ডিং বিশ্লেষণ করেছেন। এর বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয় ডোরেকো ভাষা মহাফেজ খানা থেকে। এই সংগ্রহগারে বিরল ও বিপন্ন ভাষার উচ্চমানের রেকর্ডিং সংরক্ষিত আছে। গবেষকরা এক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত কথোপকথনের উপর জোর দেন, পড়া বা লিখিত বয়ানের উপর নয়। স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম দিয়ে বাক্যাংশের সীমা শনাক্ত করা হয়। ইংরেজি, হিব্রু, রুশ ও টোটোলি ভাষায় বিশেষজ্ঞদের কৃত টীকাভাষ্যর সঙ্গে এগুলি মিলিয়ে দেখা হয়। ফলাফলে উচ্চমাত্রার সামঞ্জস্য পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে পদ্ধতিটি ভাষাভেদে নির্ভরযোগ্য। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাক্যাংশ প্রায় ০.৬ হার্জ ছন্দে সাজানো। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১.৬ সেকেন্ডে নতুন বাক্যাংশ আসে। এই সময়সীমা (১–২ সেকেন্ড) মানুষের জ্ঞান ও স্মৃতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আগের গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। অক্ষর, শব্দ, বাক্যাংশ প্রতিটি আলাদা ছন্দে প্রক্রিয়াজাত করে। ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি পরীক্ষায়ও দেখা গেছে, এই বাক্যাংশ-এর সীমান্তে মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া জন্মায়। যা নিছক ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্যের প্রতিক্রিয়া থেকে আলাদা। অর্থাৎ IU-এর সময়সীমা সরাসরি স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত। IU বা বাক্যাংশ-এর ছন্দ, শব্দাংশর গতির সঙ্গে অভিন্ন নয়। শব্দাংশ সাধারণত দ্রুততর (৪–৮ হার্জ)। কিন্তু বাক্যাংশ তার চেয়ে অনেক ধীর। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, IU-এর সময় নির্ধারণ কেবল দ্রুত বা ধীরে বলার প্রভাব নয়। বরং এটি উচ্চস্তরের পরিকল্পনার ফল। শিশুরা এই ছন্দ ব্যবহার করে কথাকে টুকরো টুকরো করতে শেখে। আর প্রাপ্তবয়স্করা কথোপকথনে পালা নেওয়ার সময় তা কাজে লাগান। এই ছন্দের ধারণা কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহলেই সীমিত নয়। বাক প্রযুক্তিতেও এর সম্ভাবনা আছে। টেক্সট-টু-স্পিচ সিস্টেম যদি বাক্যাংশ -এর ছন্দকে অন্তর্ভুক্ত করে, তবে কৃত্রিম কণ্ঠস্বর আরও প্রাকৃতিক ও সহজবোধ্য হবে। বিশেষত দীর্ঘ সময় ধরে শোনার ক্ষেত্রে। এতে শ্রোতার ক্লান্তি কমবে এবং বোধগম্যতা বাড়বে। তবে এই গবেষণার একটি সীমাবদ্ধতা আছে। একই বক্তার একাধিক রেকর্ডিং এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ভবিষ্যতে ব্যক্তিভিত্তিক ছন্দ কতটা স্থিতিশীল থাকে, তা দেখা প্রয়োজন। এছাড়া স্বাভাবিক কথোপকথনের সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বা হৃদস্পন্দনের মতো শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যাংশ ছন্দের সম্পর্কও খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
সূত্র : A universal of speech timing : intonation units from low frequency rythms by Maya Inbar, et.al ; Proceedings of the National Academy of Science ; August 19, 2025 ; (122 (34) e2425166122