১৮৮৫ সালে শিকাগোতে প্রথম আকাশচুম্বী ভবন তৈরি হয়েছিল। তাও মাত্র দশ তলা। তখন রীতিমত মানুষ ভয় পেত, সেই স্টিল-ফ্রেম কাঠামোর নীচে দিয়ে হাঁটতে। আজ বিশ্বের নানা শহরে সেই বহুতল তৈরি হচ্ছে, তবে কাঠ দিয়ে। কিন্তু মানুষের বিস্ময় আর ভয় একই রকম। একই প্রশ্নের অনুরণন, এটা কি যথেষ্ট নিরাপদ? আগুন লাগলে কী হবে? কাঠ কি এত উঁচু ভবনের ভার নিতে পারবে? তবে গবেষক ও স্থপতিদের মতে, কাঠের নির্মাণ শুধু নিরাপদই নয়, মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই বেশি স্বাস্থ্যকর। বিশ্বে মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৪০% আসে নির্মাণ শিল্প থেকে। স্থাপনার প্রধান উপাদান, ইস্পাত ও কংক্রিট, এই কার্বন ফুটপ্রিন্টের বড় উৎস। কানাডার স্থপতি মাইকেল গ্রিন বলছেন, “আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, নির্মাণের উপাদান বদলে ফেলা।“ সবুজ প্রতিষ্ঠান এম জি এ (MGA) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের মিলওয়াকিতে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ৫৫-তলার, কাঠের আকাশছোঁয়া ইমারত ডিজাইন করছে। ইমারতটি, মিলওয়াকির বর্তমান ২৫-তলা ‘অ্যাসেন্ট’ টাওয়ারকেও ছাড়িয়ে গেলো। নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশে কাঠের উঁচু ভবন দ্রুত বাড়ছে।
কাঠের টাওয়ারগুলি নজরকাড়া। প্রকৌশলীরা বলছেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারড উড’ বা প্রকৌশল প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী করা কাঠ, যেমন ক্রস-ল্যামিনেটেড টিম্বার (CLT)—নিরাপত্তা, অগ্নিরোধ এবং ভারবহন ক্ষমতায় এখন কংক্রিট ও স্টিলের সমতুল্য। এই কাঠ আগুনে সহজে ভস্মীভূত হয় না। কারণ, এর বাইরের স্তর দ্রুত দগ্ধ হয়ে ভিতরের অংশকে রক্ষা করে। তাই এর ব্যবহার বাড়ছে বহুতল, আবাসিক থেকে অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি স্থাপনার ক্ষেত্রে। একটি ২০-তলা কংক্রিট বহতলের পরিবর্তে যদি কাঠ দিয়ে সেটি তৈরি করা হয়, তাহলে প্রায় ৪৩০০ টন কার্বন নির্গমন কমানো যায়। যা প্রায় ৯০০ গাড়ির এক বছরের কার্বন নির্গমনের সমান। এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কংক্রিট উৎপাদন থেকে। ২০২০ সালে ফিনল্যান্ডের আল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, ইউরোপে পরবর্তী ২০ বছরে যদি নতুন বহুতলের ৮০% কাঠ দিয়েই তৈরি করা হয়, তবে সেক্টরটি ইউরোপীয় সিমেন্ট শিল্পের মোট নির্গমনের অর্ধেক কার্বন নির্গমন কমাতে পারবে। কংক্রিটের মতো কাঠ ‘শুকিয়ে শক্ত হতে’ ৩০ দিন লাগে না। স্থাপন করা মাত্রই এটি কাঠামোগত শক্তি দেয়। প্রিফ্যাব্রিকেটেড কাঠের প্যানেল ব্যবহার করলে, পুরো নির্মাণ সময় ২৫% পর্যন্ত কমে যায়। ফলে শ্রম খরচ ও নির্গমন কমে। তবে কাঠের দাম কিছু ক্ষেত্রে কংক্রিটের চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে। দেশ, পরিবহন ও নকশার ধরন অনুযায়ী খরচ বদলায়। গবেষক সেপ্পো জুননিলা বলছেন, কাঠের নির্মাণ দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু সমস্যার সমাধানে বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু নির্মাণ শিল্পে কাঠ ব্যবহারের জন্য দক্ষতা, মানদণ্ড ও সরবরাহ শৃঙ্খল এখনো দুর্বল। লাভ কম হওয়ায় নির্মাণ কোম্পানিগুলো পুরোনো পদ্ধতি বদলাতে অনাগ্রহী। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার চাইলে এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারে। যেমন, নতুন ভবনের কার্বন নির্গমন বাধ্যতামূলকভাবে রিপোর্ট করা, নির্গমনের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ, সরকারি ভবনে কাঠকে ‘প্রথম পছন্দ’ হিসেবে বিবেচনা করা, সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও কুইবেক ইতিমধ্যে সরকারি ভবনে ‘উড-ফার্স্ট’ নীতি চালু করেছে। একটি কাঠের ইমারত ভেঙে ফেলার পর বড় কাঠের অংশ সরাসরি আরেক ভবনে ব্যবহার করা সম্ভব হলে কার্বন নির্গমন আরও বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলিকে কুচি কুচি করে পার্টিকাল বোর্ড বানানো যায়, যদিও এ প্রক্রিয়া কয়েকবারই পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তবে স্ক্রু, ধাতু, আঠা বা শব্দরোধী কংক্রিট প্রলেপের কারণে অনেক কাঠ পুনঃব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কাঠ পরিবেশবান্ধব। কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই কাঠ সেরা নয়। স্টেডিয়াম বা অত্যন্ত প্রশস্ত কাঠামোতে অতিরিক্ত কাঠ লাগলে এই কার্বন সুবিধাই কমে যেতে পারে। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ জরুরি। কোথায় কাঠ, কোথায় স্টিল বা কংক্রিট। স্থপতি গ্রিন বলছেন, কাঠ একটি চমৎকার সমাধান হলেও ভবিষ্যতে হয়তো আরও ভালো জৈব-উপাদান আসবে। যেমন উদ্ভিদতন্তু দিয়ে তৈরি নতুন ধরনের টেকসই ও জৈব-আকৃতির নির্মাণ উপকরণ। তখন আরও সুন্দরভাবে কার্বন নির্গমন ঠেকানো যাবে।
সূত্র : Innovative engineering and smart policies can build a healthier and happier metropolis; Nature Outlook; 3 December 2025
