ক্যান্সার কোষের বিপরীত গতি

ক্যান্সার কোষের বিপরীত গতি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৩ আগষ্ট, ২০২৫

অনেকসময়ই ক্যান্সার চুপিসাড়ে কাজ শুরু করে ও হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো আক্রমণ চালায়। এই রোগ আমাদের শরীরের কোষগুলোকে বিভ্রান্ত করে। যারা সহযোগিতার দায়িত্বে ছিল তারাই হয়ে ওঠে শত্রু। চিকিৎসাবিজ্ঞান এতদিন এই ধরনের কোষগুলোকে ধ্বংস করতেই তৎপর ছিল। কিন্তু এখন এক নতুন প্রশ্ন উঠেছে, ধ্বংস না করে যদি তাদের আগের উপকারী গুণেই ফিরিয়ে আনা যায়?এই ভাবনার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি কেবল ক্যান্সার কোষ নয়, আশেপাশের ভালো কোষগুলিতেও প্রভাব ফেলে। রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়, অনেক সময় দ্বিতীয় দফার স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয়। তাই কোষগুলিকে সম্পূর্ণ মেরে না ফেলে তাদের আচরণ পাল্টানো গেলে অনেক নমনীয় চিকিৎসা সম্ভব। বিশেষত দুর্বলদের জন্য। ক্যান্সার সঠিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার আগেই কোষে নানা রকম জিন ঘটিত ও আনুষঙ্গিক পরিবর্তন হতে থাকে। এক সময় ভারসাম্য ভেঙে পড়ে এবং ঘটে যায় হঠাৎ এক পরিবর্তন। এটাকে বলে ‘সংকটময় উত্তরণ ‘। পদার্থবিজ্ঞানে যেমন ১০০°সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় জল হঠাৎ বাষ্প হয়ে যায়, তেমনি জীববিজ্ঞানের কোষেও ঘটে বিপর্যয়। কিন্তু সেটা ধরতে পারা কঠিন, কারণ প্রতিটি কোষের গতি আলাদা।
এই অনির্ধারিত মুহূর্তটিকে ধরার উপায় খুঁজে পেয়েছেন কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা। কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (KAIST)-র প্রফেসর কওয়াং-হিউন চো এবং তার দল তৈরি করেছেন ‘রিভার্ট’ নামক এক পদ্ধতি। এর পুরো অর্থ, পশ্চাৎমুখী উত্তরণ (Reverse Transition)। রিভার্ট মূলত প্রতিটি কোষের জিন-ক্রিয়া রেকর্ড করে, তার অন্তর্গত পরিক্রমার নকশা বানায় এবং কম্পিউটারে সিমুলেশন চালিয়ে দেখে, ক্যান্সার শুরু হলে কোষের সংকেত কেমনভাবে বদলায়। এই সিমুলেশনের বিশেষত্ব হলো, এটি সাধারণ গাণিতিক সমীকরণের পরিবর্তে বুলিয়ান লজিক ব্যবহার করে। প্রতিটি জিন হয় সক্রিয় (on) নয়তো নিষ্ক্রিয় (off)—এই হ্যাঁ/না ভিত্তিক পদ্ধতিকে বলা হয় বুলিয়ান লজিক বলে। এই সরলীকরণ বিশাল শক্তিশালী একটি মানচিত্র তৈরি করে। এই মানচিত্রে প্রতিটি কোষের সম্ভাব্য স্থিতিশীল অবস্থানগুলোকে ‘আকর্ষণকারী ‘ বা ‘attractor’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায় কোন কোন সুইচ পরিবর্তন করলে কোষ ক্যান্সারের পথে না গিয়ে সুস্থ আচরণে ফিরে যাবে। গবেষকরা বিশ্লেষণ করে ক্যান্সার ঝুঁকির স্কোর নির্ধারণ করেন। কম স্কোর মানে স্বাস্থ্যকর কোষ, আর বেশি স্কোর মানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ ক্যান্সার-ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ। এইভাবে এক একটি জিনের সুইচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা হয়, কোন সুইচ বন্ধ করলে স্কোর নীচে নামে। কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের উপর এর প্রথম বাস্তব পরীক্ষা চালানো হয়। দেখা যায়, MYC নামের একটি জিন, যা বহু ক্যান্সারে ‘অতিরিক্ত গতি’ দেয়, সেটি বন্ধ করলেই পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়। কিন্তু পুরোপুরি নয়। তারপর আসে YY1 নামের আরেকটি জিন। MYC আর YY1-কে একটি জোড় (টগল) সুইচের মতো ব্যবহার করে দেখা যায়, যদি এটিকে একদিকে ধরা যায়, তাহলে ক্যান্সারের দিকে এগোয়। আবার অন্যদিকে নিলে কোষ স্বাভাবিক আচরণে ফিরে আসে। চো বলেন, “এই রূপান্তরের ক্ষণিক মুহূর্তে আমরা এক ‘আণবিক সুইচ’ খুঁজে পেয়েছি, যা ক্যান্সার কোষকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে পারে।” এই গবেষণায় দেখা গেছে, USP7 নামের আরেকটি জিনকে কমিয়ে দিলে, রোগীর কোষ থেকে ল্যাবে তৈরি ক্ষুদ্র অঙ্গসদৃশ কোষগুলোর গঠন আবার স্বাভাবিক হতে থাকে। কোষগুলো আর আগের মতো হুহু করে বাড়তে চায় না, বরং গুটিয়ে থাকে। এখনো অবশ্য এই গবেষণা পরীক্ষাগারেই সীমাবদ্ধ। ভবিষ্যতে ক্রিসপার জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি ও উন্নত আর এন এ প্রযুক্তির সাহায্যে এই সুইচগুলিকে জাগিয়ে তুলে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিপ্লব আনা সম্ভব। CRISPR-ভিত্তিক জিন সম্পাদনা জীবিত জীবের মধ্যে ডিএনএ অনুক্রম খুবই নিখুঁতভাবে পরিবর্তন করার সুযোগ করে দেয়। গবেষণা, রোগ নির্ণয় এবং সম্ভাব্য চিকিৎসার জন্য এ এক শক্তিশালী হাতিয়ার, যার মাধ্যমে জিনগত ত্রুটি সংশোধন করা এবং জিনের কার্যকারিতা বোঝা সম্ভব।
এই গবেষণা শুধু ক্যান্সার নয়, স্টেম সেল গবেষণাতেও গুরুত্বপূর্ণ হবে। কোষকে ঠিক কোন পথে চালনা করলে হৃদযন্ত্র, প্যানক্রিয়াস বা স্নায়ুকোষ গঠন করা যায়, সেই নির্দেশনাও এতে স্পষ্ট হবে। সুতরাং ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস না করে তাকে থামালে হয়তো চিকিৎসার এক অন্যরকম দিগন্ত খুলে যাবে।

সূত্র : Open Access Attractor Landscape Analysis Reveals a Reversion Switch in the Transition of Colorectal Tumorigenesis by
Dongkwan Shin, et.al ; Advanced Science (Volume 12 ; Issue 8), (22 January 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 1 =