গজ-কৃষ্টি সংকট

গজ-কৃষ্টি সংকট

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৬ মে, ২০২৫

বন্য জীবনে যাপন কেবল ‘প্রবৃত্তি’র উপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রেও কষ্টার্জিত, বংশগত এবং সামাজিক জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে। হাতিদের মধ্যে, এই জ্ঞান এবং সংস্কৃতির রক্ষক হল তাদের দলের প্রবীণরা। শত শত বছর ধরে, তারা খরা, বিপদ এবং অভিবাসনের মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব পালকে পরিচালিত করে চলে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, তাদের এই জ্ঞানের শৃঙ্খল ভেঙে পড়তে দেখা যাচ্ছে। পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক এক গবেষণা দেখাচ্ছে, মানুষ তাদের শিকার করছে, তাদের আবাসস্থল ভেঙে গড়ে তুলছে নিজের বাড়ি। ফলে তাদের গোষ্ঠীর উপর বিপদ নেমে আসছে। এতে যে কেবল এক-দুই করে, হাতির সংখ্যা কমছে তা নয়, বরং প্রজন্ম-বাহিত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগও ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গবেষণাটি, একটি নীরব সংকটের দিকে আমাদের মনোযোগের দাবি রাখে। বয়স্ক হাতিদের হারানোর ফলে, এদের টিকে থাকা, এদের সামাজিক ও কৃষ্টিগত কাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
দলনেতা বিহনে হাতি সমাজ আরও ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। এমনকি যা হারিয়ে যাচ্ছে, তা আর কখনও ফিরে নাও আসতে পারে! সামাজিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল প্রাণীদের মধ্যে একটি হল হাতি। তারা প্রায়শই একজন মাতৃপতিকে কেন্দ্র করে, ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বর্গে বাস করে। এই নেত্রী কেবল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বই নন – শিক্ষক, পথপ্রদর্শক এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের অভিভাবকও বটে। তাদের স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা বিস্তৃত। খরা, বিপদ এবং নিরাপদ স্থানের ইঙ্গিত এরাই সবচেয়ে ভালো জানে ও বোঝে। জীবনের সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য ছোট হাতিরা এই মাতৃপতির উপর নির্ভর করে। তার সাহায্য কিংবা নির্দেশনা ছাড়া, দলগুলি তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ সন্ধানে ব্যর্থ হতে পারে। এমনকি কোন বিপদকে ভুলভাবে মূল্যায়ন করতে পারে, অথবা কোনো চাপের মুখে ভেঙে পড়তে পারে। প্রধান গবেষক ডঃ লুসি বেটস একথা উল্লেখ করেছেন। অভিজ্ঞ দলনেতাদের অপসারণের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়েই এই গবেষণা চালানো হয়েছে। হাতির জনসংখ্যার উপর সামাজিক ব্যাঘাতের প্রভাব সম্পর্কে এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণ। এটিতে, আফ্রিকান সাভানা হাতি, বুনো হাতি এবং এশিয়ান হাতি সহ ৯৫টি নির্ভরযোগ্য গবেষণার তথ্য সংশ্লেষণ করা হয়। তিনটি প্রজাতিরই গভীর কৃষ্টিগত শিক্ষার লক্ষণ স্পষ্ট। সেই শিক্ষার মধ্যে রয়েছে মৌসুমী খাদ্যের উৎস চিহ্নিত করা, অভিবাসনের পথরেখা মনে রাখা এবং শিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা। এই আচরণগুলি জিনগতভাবে প্রোথিত থাকে না।, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে। হাতিরা তাদের প্রবীণদের চারপাশে জড়ো হয়, অপরিচিত পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে, প্রবীণদের সিদ্ধান্তগুলি অনুকরণ করে। এই সুযোগগুলি না পেলে তাদের দক্ষতাগুলিও ক্ষীণ হয়ে পড়ে, পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ! তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার গোটা কাঠামোটাই হারিয়ে ফেলে, অথচ এই কাঠামোগুলি বিশেষ করে পরিবর্তিত পরিবেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত, বিচক্ষণ সিদ্ধান্তগুলি বেঁচে থাকার উপর নির্ভর করে। তখন দলগুলি স্বল্প বিপদের আঁচে, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে, আবার প্রকৃত বিপদ চিনতে ব্যর্থ হয়। ফলত বাচ্চা হাতিগুলির বেঁচে থাকার হার হ্রাস পেতে থাকে, দলগত সংহতি দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি প্রজনন হ্রাস পায়। সংখ্যার একটি সাধারণ ঘাটতি আসলে জ্ঞান স্থানান্তরের একটি গভীর, পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ‘খাদ’। হাতি সমাজে, প্রতিটি প্রবীণই যেন এক একটি চলমান গ্রন্থাগার। প্রতিটি গ্রন্থাগারে কয়েক দশকের পরিবেশের এবং সামাজিক জ্ঞান সঞ্চিত রয়েছে যার উপর তরুণরা নির্ভর করে। প্রায়শই হাতির দাঁতের জন্য একজন মাতৃপতিকে হত্যা করা হয়। সেই ক্ষতির অনুরণন দলের মধ্যে তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। ফলস্বরূপ বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা এবং দলের নেতৃত্বে ভাঙন দেখা দেয় ।হাতি সমাজে প্রবীণরা জ্ঞানের শুধু ভাণ্ডার নয়, রক্ষকও বটে। এই সামাজিক বন্ধন সংরক্ষণ করা, তাদের আবাসস্থল রক্ষার মতনই গুরুত্বপূর্ণ। ডঃ বেটস এইভাবে ব্যাখ্যা দেন।
দলনেত্রীকে হারিয়ে ফেলা, হাতিদের উপর দীর্ঘমেয়াদী মানসিক এবং আচরণগত প্রভাব ফেলে। বিশৃঙ্খল দলে বেড়ে-ওঠা হাতিরা কেবল অজ্ঞই হয় না, বিপজ্জনকভাবে অনিয়মিতও হয়ে পরে। সঠিক পরামর্শ ছাড়াই অল্পবয়সী হাতি, গন্ডারকে, যানবাহনকে এমনকি গ্রামে আক্রমণ করতে শুরু করে। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে সামাজিক শিক্ষা ছাড়া, হাতিরা সামাজিকভাবে বিপথগামী হয়ে যায়। মানসিক নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক সংযম এবং দলের মধ্যে তার নিজস্ব ভূমিকার বোধ, এগুলিই হল সামাজিক শিক্ষা। আচরণগত পরিবর্তনের পাশাপাশি, এতিম গোষ্ঠীগুলি বৃহত্তর সামাজিক সংযোগ-জালে একীভূত হওয়ার কাজে ব্যর্থ হতে পারে। হাতি সমাজ স্তরবদ্ধ এবং জটিল। এর মধ্যে বন্ধু, প্রতিদ্বন্দ্বী, পরামর্শদাতা এবং দূরবর্তী আত্মীয় সবই রয়েছে। প্রবীণরা প্রায়শই সম্পর্কের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে, স্থিতিশীলতা বজায় রাখে এবং পারস্পরিক সহযোগিতাকে উৎসাহ দেয়। ফলে তাদের অনুপস্থিতি হাতি-সমাজের পতন ডেকে আনে, দলের ভিতরে ও বাইরে মতবিরোধ বাড়িয়ে তোলে, বিভেদ প্রকট হয়। সংরক্ষণবাদীরা কখনও কখনও শিকারীদের হাত থেকে বা আবাসস্থলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য, তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। কিন্তু গবেষকরা সতর্ক করছেন, এক্ষেত্রে সামাজিক কাঠামোর বিষয়টি বিবেচনা না করলে অপ্রত্যাশিত বিপত্তি হতে পরে। মানব সম্প্রদায় যেমন ইতিহাস, স্মৃতি এবং ঐতিহ্য দ্বারা গঠিত, হাতি সমাজও তাই। যেসব হাতি তাদের মূল সামাজিক সঙ্গী ছাড়াই স্থানান্তরিত হয়, তারা বিভ্রান্তি, বিষণ্ণতায় ভোগে, এমনকি মৃত্যুযন্ত্রণাও ভোগ করতে পারে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দিতে পারে। অন্যদিকে, তারা নতুনদেরও মেনে নিতে পারে না, তাদের আপদ হিসাবে দেখতে পারে।
তাই সংরক্ষণকে ভূমি এবং আইনের চেয়েও বেশি গভীরে গিয়ে বুঝতে হব। হাতি সমাজের কৃষ্টি-বন্ধন এক প্রজন্মের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটি অক্ষত থাকলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দলকে সুস্থ ও সুষ্ঠভাবে টিকিয়ে রাখবে। এর অর্থ হল মাতৃনেতাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের সুরক্ষা-দেওয়া গোষ্ঠীর মধ্যে জ্ঞান ধারণের পথকে বোঝা। আফ্রিকার বুনো এবং এশিয়ান হাতি প্রজাতিগুলিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করাও প্রয়োজন- যাদের সামাজিক জীবন এখনও খুব একটা বোঝা যায়নি। “হাতির সামাজিক জীবন বোঝা এবং সুরক্ষা করা এখন আর ঐচ্ছিক বিষয় নয়। ক্রমবর্ধমান মানব-অধ্যুষিত বিশ্বে এই দুর্দান্ত প্রাণীদের উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য এটি আবশ্যিক,” শ্যানন বলেন। হাতিরা মনে রাখে। তাদের স্মৃতিতে মানচিত্র, ইতিহাস এবং সম্পর্ক চিত্রিত থাকে। যখন আমরা সেই স্মৃতিগুলিকে ভেঙে ফেলি, তখন আমরা কেবল বর্তমানকেই আহত করি না – আমরা ভবিষ্যতকেও মৃত্যুমুখে ঠেলে দিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + 13 =