গাছের পাতা চিনির ফাঁদ

গাছের পাতা চিনির ফাঁদ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গাছকে আমরা সাধারণত শান্ত, নিশ্চুপ এক জীব ভেবে থাকি। কিন্তু প্রকৃতির অন্দরে তাদেরও চলে তীব্র লড়াই। পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকানো থেকে শুরু করে ফুলে পরাগ পৌঁছে দেওয়ার মতন অনেকগুলি দ্বন্দ্বময় খেলা চলে। সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা দেখাচ্ছে, এই লড়াইয়ে গাছরা আশ্চর্য কৌশল নিয়েছে, চিনি দিয়ে ঘুষ! আমরা জানি, ফুলে মধু থাকে মৌমাছি বা প্রজাপতিকে টানতে। কিন্তু অনেক গাছেই থাকে পুষ্প বহির্ভূত মধুভান্ডার। অর্থাৎ পাতায় বা ডাঁটায় চিনি নির্গত করার গোপন ছোট ছোট গ্রন্থি। এই মিষ্টির গন্ধে ছুটে আসে পিপীলিকা। তারা মধু খেয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। বিনিময়ে গাছকে করে রক্ষা। শিকারি পোকা বা পাতাখেকো পতঙ্গকে তাড়িয়ে দেয় যেন দেহরক্ষী! শুনতে সহজ মনে হলেও এতেও রয়েছে অনেকগুলি সমস্যা । ফুলের খুব কাছে যদি এই চিনি ফাঁদ বসানো হয়, তখন পিঁপড়েরা ফুলেই ভিড় জমায়। আর তখনই বিপাকে পড়ে মৌমাছিরা। তাদের ফুলে ঢুকে কাজ করতে বাধা পড়ে, পরাগায়ন কমে যায়। সদ্য প্রকাশিত এই বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ২৫টি উদ্ভিদ প্রজাতির ২৭টি পরীক্ষা। দেখা গেছে, ফুলের কাছে মধু থাকলে মৌমাছির মতো পরাগবাহীরা ফুলে কম সময় কাটায়।

বরং দূরের পাতায় বা ডাঁটাগুলিতে এই চিনির রস বা মধু থাকলে ফুলে মৌমাছির আসা-যাওয়ায় তেমন সমস্যা হয় না। উপরন্তু গাছ পায় দ্বিগুণ সুবিধা – শত্রুপোকা থেকে সুরক্ষা এবং স্বাভাবিক পরাগায়ন। প্রজাপতির মতো দীর্ঘ শুঁড়ওয়ালা পোকাদের উপর প্রভাব তুলনামূলক কম। কারণ তারা দূর থেকেই ফুলের মধু সংগ্রহ করতে পারে। গাছের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রজনন, ফল ও বীজ উৎপাদন। গবেষকরা দেখেছেন, কোথায় মধু থাকবে তার উপর নির্ভর করছে সেই সাফল্যের হার। ফুলের একেবারে গায়ে থাকলে ফলন কমতে পারে। দূরে থাকলে, ফলন বাড়তে দেখা যায়। অর্থাৎ “চিনির ঘুষ” সব সময় লাভজনক নয়। কখনও সেটা পরিণত হয় উল্টো ফাঁদে। এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, উদ্ভিদের বিবর্তন অনেক বেশি সূক্ষ্ম কৌশলের উপর গড়ে উঠেছে। কিছু গাছ ফুলের বদলে পাতায় মধু তৈরি করে সমঝোতা করেছে।

আবার কিছু প্রজাতি ঋতুভেদে আলাদা কৌশল নেয়। কখনও ফুলে, কখনও পাতায় মিষ্টির ঘুষ চালু করে। প্রশ্ন উঠছে, এই দ্বন্দ্বময় সম্পর্কই কি গাছের বহুবিধ প্রজনন কৌশলের জন্ম দিয়েছে? প্রকৃতির এই “ঘুষের অর্থনীতি” আমাদের জন্যও শিক্ষণীয়। গাছে কোথায় মধু থাকলে সঠিক ফলন বাড়বে তা জানতে পারলে, কৃষিক্ষেত্রে নতুন কৌশল আনা যাবে।

একইসঙ্গে বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণেও সাহায্য করবে। গাছ, পোকামাকড় ও পরাগবাহীর সম্পর্ক প্রকৃতির ভারসাম্যের মূল চাবিকাঠি। গাছ নীরব হলেও বেঁচে থাকার জন্য চালায় জটিল রাজনৈতিক খেলা। কখনো “চিনি ঘুষে” নিযুক্ত দেহরক্ষী, কখনও ঝুঁকি নিয়ে পরাগবাহীর সঙ্গে সমঝোতা। এই লুকোনো কৌশলগুলোই প্রমাণ করে, প্রকৃতির প্রতিটি শাখায় চলছে বেঁচে থাকার এক অনন্ত সমীকরণ।

 

সূত্র : Ants on flowers: Protective ants impose a low but variable cost to pollination, moderated by location of extrafloral nectaries and type of flower visitor byAmanda Vieira da Silva ; Journal of Ecology (18 June 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − eighteen =