
বলিভিয়ার মরুভূমির নিস্তব্ধ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ‘ঘুমন্ত দানব’- উতুরুনকু। প্রায় ২.৫ লক্ষ বছর আগে আগ্নেয়গিরিটি থেকে শেষবার অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে এই আগ্নেয়গিরি মাঝে মাঝেই শ্বাস নেয়, হেঁচকি তোলে, আর ভূমিকম্পের ছোট ছোট কম্পনে দেয় তার জীবিত থাকার প্রমাণ। এই অর্ধমৃত অর্ধ জীবন্ত আগ্নেয়গিরিকে বলা হয় ‘জম্বি আগ্নেয়গিরি’। এর রহস্যভেদে নেমেছেন চীন, যুক্তরাজ্য ও আমেরিকার এক গবেষক দল। সিসমিক টোমোগ্রাফি আর শিলা বিশ্লেষণ করলেন তারা। সিসমিক টোমোগ্রাফি হল একটি শক্তিশালী ইমেজিং পদ্ধতি, যার সাহায্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন ও গতিবিধি বোঝা যায়, ভূকম্পনের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করা যায়। গবেষকরা জানান, উতুরুনকু-র অস্থিরতার কারণ, লাভা গলে যাওয়া নয় বরং উত্তপ্ত তরল ও গ্যাসের চাপ। উতুরুনকু-র চারপাশে ঘটছে এক অদ্ভুত ঘটনা। মাঝে মাঝেই ভূমি ফুলে উঠছে কিংবা কোথাও জমি নীচে বসে যাচ্ছে। যেন মাটির নিচে কেউ হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে! এই গঠনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সম্ব্রেরো বিকৃতি’। আগ্নেয়গিরির গভীরে কিছু একটা চলছে, তবে সেটা বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নয় বরং জমে থাকা এক বিস্ময়কর চাপ। গবেষকরা ভূমিকম্প থেকে আসা ১,৭০০-টিরও বেশি কম্পনের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করেছেন আগ্নেয়গিরির নিচের এক বিশদ ত্রিমাত্রিক মানচিত্র। এই মানচিত্রেই ধরা পড়ে যে উতুরুনকুর নীচে গ্যাস ও তরল জমছে। এগুলো আসছে জল -তাপীয় সিস্টেম দিয়ে। উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তপ্ত তরল উপরে উঠছে, কিন্তু মুখ থেকে বেরোচ্ছে না, এক জায়গায় জমা হয়ে এই চাপ তৈরি করছে, সেটাই ভূমিকে উপরের দিকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। অর্থাৎ, অগ্ন্যুৎপাত মানেই আগুন নয়, কখনো কখনো সেটা হতে পারে অজানা এক ভূগর্ভীয় ষড়যন্ত্র। তবে, এই আবিষ্কারের হাত ধরে বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত করেছেন, এই মুহূর্তে উতুরুনকু থেকে বিপজ্জনক অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই। ম্যাগমা বা লাভা এখনও শিলার মধ্যে আটকে আছে। আটকে আছে তরলগুলিও। শুধু আটকে থাকা নয় সেগুলি স্থিরভাবে জমা হচ্ছে। তবে বিষয়টি এতটাও সহজ নয়, জমে থাকা তরল হঠাৎ করে উথলে উঠতেও পারে যেকোনও সময়!
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মাইক কেন্ডাল বলেন, “আমরা কাজটি করতে গিয়ে বুঝেছি কীভাবে আগ্নেয়গিরির নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে বোঝা যায়, বিপদ কত দূরে।” চীনের অধ্যাপক হাইজিয়াং ঝাং বলেন “এই কাজ শিলার গঠন, তরলের প্রবাহ এবং কম্পনের তথ্য সব মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি দিয়েছে।” গবেষকরা আশা করছেন, এই মডেল পৃথিবীর আরও বহু ‘নিঃশব্দ কিন্তু সক্রিয়’ আগ্নেয়গিরির ভিতরের গঠন বুঝতে সাহায্য করবে। ১৪০০-টিরও বেশি এমন আগ্নেয়গিরি আছে যাদের সক্রিয় মনে করা হয় না অথচ ভিতরে চলতেই পারে নিঃশব্দ আন্দোলন! উতুরুনকু হয়তো এখনই বিস্ফোরণ ঘটাবে না, কিন্তু সে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—সব নীরবতা আন্দোলনহীন নয়। কিছু নীরবতা হতে পারে ঝড়ের আগমনী বার্তা।