জলবায়ু সংকট, প্রজাতি সংকট

জলবায়ু সংকট, প্রজাতি সংকট

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১২ আগষ্ট, ২০২৫

কেবলমাত্র জঙ্গল সাফাই আর শিকারের কবলে পড়া নয়, পৃথিবীর বন্যপ্রাণীদের কাছে বড় হুমকি এখন জলবায়ু পরিবর্তন। এক বিশাল গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ৩,৫০০টি প্রাণী প্রজাতি সরাসরি তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, ঝড় ইত্যাদি নানান জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ে আক্রান্ত। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ উইলিয়াম রিপল। বিশেষত অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা বেশি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সমুদ্রের প্রাণীরা অনেক বেশি সংকটাপন্ন, কারণ জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তারা এই উষ্ণজল থেকে ঝট করে সরে যেতে পারে না। রিপলের ভাষায়, “আমরা পৃথিবীর প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকটের প্রাথমিক ধাপে দাঁড়িয়ে। আগে শিকার আর আবাসস্থল ধ্বংসই ছিল মূল কারণ। এখন জলবায়ু বদলের চাপ তৃতীয় প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” ৭০,৮১৪টি প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬টি অমেরুদণ্ডী শ্রেণীর (যেমন – আরাকনিড, সেন্টিপিড, অ্যান্থোজোয়ান) অন্তত ২৫% প্রজাতিই জলবায়ু ঝুঁকির মুখে। স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ সব শ্রেণীতেই কিছু না কিছু জলবায়ু বিধ্বস্ত সদস্য রয়েছে। সমুদ্র সেই বিপদের কেন্দ্রে। কারণ, গ্রীনহাউজ প্রভাবের অতিরিক্ত তাপের বড় অংশই শোষণ করে সমুদ্রের জল। রিপলের আশঙ্কা, “সমুদ্রের অমেরুদণ্ডী প্রাণীরাই বেশি বিপন্ন। কারণ তাদের স্থানান্তরের ক্ষমতা নেই।” এই সংকটের সারা বছরের ছবি তুলে ধরে প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক সংস্থা IUCN Red List । এই তালিকায় কোন প্রজাতি কতটা বিপন্ন, তা ধারাবাহিকভাবে নথিভুক্ত হয়। এটি শুধু তথ্য নয়, সংরক্ষণের মানচিত্রও। সরকার, গবেষক, স্থানীয় মানুষ সবাই সিদ্ধান্ত নেয় এই তালিকাকে ভিত্তি করে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের সরাসরি প্রভাব ইতিমধ্যেই চোখে পড়েছে। ইজরায়েলের উপকূলে সামুদ্রিক ঝিনুকের ৯০% হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালে ‘প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট হিট ডোমে’র সময় কয়েক বিলিয়ন ক্ল্যাম(পুরু খোলকের সামুদ্রিক শামুক), স্নেইল(ঝিনুক), মুসেল(সামুদ্রিক শামুক) মারা যায় কয়েক দিনের মধ্যেই।’প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট হিট ডোম’ হল, উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে (যেমন: কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন, ওরিগন প্রদেশ) ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ উষ্ণতা বৃদ্ধি। সেখানে তাপ একটি “ডোম” বা গম্বুজের মতো আটকে পড়ে দীর্ঘ সময় ধরে অঞ্চলের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ২০১৬ সালের সাগর উত্তাপ তরঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের ৩০% প্রবাল ফিকে হয়ে যায়। স্থলজ এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের অবস্থাও ভালো নয়। ২০১৫–১৬ সালের উষ্ণ আবহাওয়ায় উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে খাদ্যচক্র ভেঙে পড়েছিল। চার কোটি ‘সামুদ্রিক মার পাখি’ মারা যায়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কড মাছ ৭১% কমে যায়। হারিয়ে যায় ৭,০০০ হাম্পব্যাক তিমি । রিপলের সতর্কবার্তা, “এইরকম বারংবার মৃত্যুর ঢেউ কার্বন সাইকেল ও পুষ্টি চক্রেও প্রভাব ফেলবে।” এই গবেষণা বরফের চূড়া মাত্র। পৃথিবীর ১০১টি প্রাণী শ্রেণীর মধ্যে ৬৬টি শ্রেণী এখনও জলবায়ু ঝুঁকির নিরীক্ষণের বাইরে। গবেষণার বিশ্লেষণ মাত্র ৫.৫% চিহ্নিত প্রাণীকেই অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে। রিপল বলছেন, “জলবায়ু ঝুঁকির কার্যকর নীতি চাইলে, তার প্রকৃত চিত্র বুঝতেই হবে। আমাদের দরকার বিশ্বস্তরের তথ্য, তদারকি। বিশেষভাবে অগোচরে থাকা প্রজাতিদের নিয়মিত নজরের আওতায় আনা।”
অমেরুদণ্ডী প্রাণী যারা পরাগায়ন, মাটির স্বাস্থ্য এবং সামুদ্রিক খাদ্যচক্রের মেরুদণ্ড, তাদের দিকেই সবচেয়ে কম নজর পড়ে। তাই জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার মধ্যে বৈশ্বিক সমন্বয় ঘটাতে হবে। শুধু তাপমাত্রা মাপলে চলবে না। তাদের জিনগত বৈচিত্র্য কতটা, তাও বোঝা জরুরী। জলবায়ু সংকট এখন আর দূরবর্তী বিপদ নয়।একেবারে ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তব। তাই কোন প্রজাতি বাঁচবে আর কোন প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তা নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের উপর।

তথ্যসূত্র : Climate change threats to Earth’s wild animals by
William J Ripple , et.al ; BioScience, (20 May 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 4 =