ধরা যাক একটি প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে। জীববিজ্ঞানের ধারণা তেমনই। তারপর হঠাৎই দেখা মিললো সে প্রাণীর। ফসিলে নয়। জীবন্ত, চলে ফিরে বেড়াচ্ছে।
বিশ্বাস হলো না ঠিক! এ আবার হয় নাকি?
বিজ্ঞানে প্রায় সবই সম্ভব।
১৯৩৮ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর দক্ষিন আফ্রিকার পূর্ব উপকূল চালুমান নদীর মোহনায়( এখন নাম টায়ালোনকা) স্থানীয় মাছ শিকারীদের একটি জালে দেখা গেল একটি নতুন রকমের মাছ। নীল রঙের মাছটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ ফুট। ওজন প্রায় ৮০ কেজি। পাখনায় যেন মাংস ঝুলে আছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন হ্যাণ্ড্রিক গুসেন মাছটি দেখে প্রথমে খানিক অবাক হয়েই জাহাজে তুলে ভালো করে ধুলেন। ধোয়ার পর যেন জ্বলে উঠছে মাছটি। স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটর মার্জোরি কোর্টনি ল্যাটিমার আগেই জেলেদের বলে রেখেছিলেন অপরিচিত মাছ পেলে যেন তাঁকে খবর দেওয়া হয়। তিনি খানিক বেশি দাম।দিয়েই কিনবেন। গুসেন তাড়াতাড়ি ভদ্রমহিলার কাছে মাছটি পাঠিয়ে দিলেন। ল্যাটিমার মাছ কিনে জাদুঘরে রাখলেন বটে, কিন্তু এটিকে সংরক্ষণ করবেন কী করে? রেফ্রিজারেটর নেই তখন, মর্গের লোকেরা মর্গে মাছ রাখতে রাজি নন। এদিকে মৎসবিজ্ঞানের যাবতীয় বই ঘেঁটে কিছুই পেলেন না। তখন ট্যাক্সিডার্মি করে রাখা হলো মাছটিকে। মৃত প্রাণীর চামড়া ব্যবহার করে তার মধ্যে খড় বা অন্য কিছু ভরে তার জীবন্ত রূপ ফুটিয়ে তোলার নাম ট্যাক্সিডার্মি। সংরক্ষণ করে রাখলেন আঁশগুলি। ল্যাটিমার পাশাপাশি কয়েকটা আঁশ ও একটা স্কেচ করে পাঠিয়ে দিলেন রোড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী জেমস স্মিথের সাথে। স্কেচ দেখে আঁশ পরীক্ষা করে বিষ্মিত স্মিথ। প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছ। এও কি সম্ভব! স্মিথ এরপর জাদুঘরে গিয়ে সচক্ষে দেখলেন সংরক্ষিত মাছটি। একশ বছর আগে মার্কিন বিজ্ঞানী লুই আগাসিজ এই মাছের জীবাশ্ম আবিষ্কার করে মাছটির নাম রখেছিলেন সিলিকান্থ। ল্যাটিমার এবং স্মিথের অনুসন্ধানের পর সিলিকান্থ জীবন্ত জীবাশ্ম নামে পরিচিত। জীবন্ত জীবাশ্ম কেননা লুপ্ত না হয়েও কোটি কোটি বছর আগের বৈশিষ্ট্য অটুট রেখেই রয়েছে তাই। ল্যটিমার ও চালুমনে নদীর নাম অনুসারে সিলিকান্থের বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হলো ল্যাটিম্যারিয়া চালুমানে। স্মিথের মনে দানা বাধলো এক বাসনা – যদি আরো কোনো জেলের জালে ঊঠে আসে মাছটি। তাই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছেপে অর্থমূল্য ঘোষণা করে দিলেন তিনি।
প্রায় ১১ বছর পরে ১৯৫২ র ডিসেম্বরে আফ্রিকার কমো দ্বীপের এক মৎসজীবী একটি ৩৭ কেজি ওজনের সিলিকান্থ ধরেন। মুশকিলের বিষয় তিনি বিজ্ঞাপনের কথা জানতেন না। ফলে আঁশ ছাড়িয়ে ফেলেছেন এমন সময় এক শিক্ষক তাকে খবর দেওয়াতে অনেক কষ্টে স্মিথের সাথে যোগাযোগ করে ফর্মালিন দিয়ে মাছটিকে পাঠিয়ে দিলেন। এরপরে ১৯৭৫ ও ১৯৮৪ সালে সিলিকান্থ ওঠে জালে। ১৯৯৭ সালে ইন্দোনেশয়ার মেনাদো তুয়া দ্বীপে দ্বিতীয় আর এক প্রজাতির সিলিকান্থ পান এক মৎস্যজীবী। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ জীববিজ্ঞানী আর্ডম্যান হানিমুনে গিয়ে স্থানীয় মাছের বাজার থেকে আনকোরা মাছের ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়াতে গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সিলিকান্থ গবেষকের নজরূ আসে। তাঁরা গবেষণা করে জানান এটি নতুন প্রজাতির সিলিকান্থ। মেনাদো তুয়া দ্বীপের জন্যে বিজ্ঞানসম্মত নাম রাখা হয় – ল্যাটিমারিয়া মেনাদোয়েনসিস।
আটটি পাখনা যুক্ত মাছটি ওজনে ৯০ কেজি পর্যন্ত, দৈর্ঘে ৬.৬ ফুট পর্যন্ত হয়। বাঁচে প্রায় ৬০ বছর। মাংসল পাখনার জন্যে সমুদ্রের নিচের মাটিতে ভর দিয়ে চলে। মাংসল পাখনার পারিভাষিক নাম লবড ফিন।
এখনো পর্যন্ত কেনিয়া, দক্ষিন আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়া, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক, আফ্রিকার কমোর দ্বীপে সিলিকান্থ পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে সিলিকান্থের জিনোম সিকোয়েন্স করেছে ক্রিস অ্যামেমিয়া, নীল সুবিন এবং তাঁদের দল। বিজ্ঞানীদের ধারণা এখনো পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ টি সিলিকান্থ রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এত কোটি বছরে বিবর্তিত না হয়ে কীভাবে টিঁকে আছে সিলিকান্থ? পরবর্তী গবেষণায় হয়তো উত্তর মিলবে।