জৈব ঘড়ির প্রোটিন-ছন্দ

জৈব ঘড়ির প্রোটিন-ছন্দ

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১২ আগষ্ট, ২০২৫

একটি মানুষের চুলের চেয়েও পাতলা একফোঁটা কৃত্রিম জৈব বস্তু একটা নিখুঁত ঘড়ির মতো চার দিন ধরে একটানা সময় ঠিকঠাক রেখে চলেচছে! ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (মার্সেড) বায়োইঞ্জিনিয়ার আনন্দ বালা সুব্রহ্মণ্যম ও রসায়নবিদ অ্যান্ডি লিওয়াংয়ের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল সায়ানোব্যাকটেরিয়ার জৈব ঘড়ি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ ঘড়ি হল তিনটি প্রোটিন – KaiA, KaiB, KaiC। তাঁরা এই তিন প্রোটিনকে একটি ছোট্ট ফ্যাট-বুদ্বুদের মতো কৃত্রিম কোষে স্থাপন করেন। এই ত্রয়ী প্রোটিন দিনরাত ২৪ ঘণ্টার ছন্দে জ্বলজ্বল করেছে। টানা চার দিন ধরে!

গবেষণায় প্রমাণ হয়, সঠিকভাবে চলতে জৈব ঘড়ির অন্য কিছুর দরকার নেই- কেবলমাত্র এই তিনটি প্রোটিনই যথেষ্ট। সায়ানোব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সব জীবের শরীরে ঘড়ির মতো চলা “সার্কাডিয়ান ক্লক” ঘুম-বিশ্রাম, হরমোন, তাপমাত্রা ও বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। সার্কাডিয়ান ক্লক হলো একটি অভ্যন্তরীণ জৈব সময় নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থা, যা জীবের শরীরে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ও আচরণগত প্রক্রিয়া প্রায় ২৪ ঘণ্টার একটি চক্র অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে।
এই অভ্যন্তরীণ ঘড়ি, যাকে ‘সার্কাডিয়ান ছন্দ’ বলেও ডাকা হয়, তা শরীরের কার্যক্রমকে বাইরের পরিবেশের, বিশেষ করে দিন-রাত্রির পরিবর্তনের, সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু জীবন্ত কোষের মধ্যে তা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কথা। যেমন, প্রোটিন চলে, ধাক্কা খায়, তার কোষ বিভাজন হয়। তাহলে এত বিশৃঙ্খলার মধ্যে সময় এমন নিখুঁত চলে কিভাবে? গবেষকরা টেস্ট টিউবে বিশুদ্ধ Kai প্রোটিনগুলো বানিয়ে সেগুলো ছোট ছোট লিপিড ভেসিক্‌লে ঢুকিয়ে দেন। সঙ্গে রাখেন একটি ফ্লুরোসেন্ট টিকলি, যাতে ঘড়ির ছন্দ দেখা যায়। দেখা যায়, ছোট্ট কৃত্রিম কোষগুলিতে KaiC নিজেকে ফসফেট সংযুক্ত ও বিচ্ছিন্ন করার ধীর লয়ে কাজ করল আর KaiA-B তাকে ঠেলা দিল, এ যেন ঘড়ির কাঁটা ঘোরানোর আণবিক গিয়ার। কিন্তু প্রতিটি কোষে ঘড়ি ঠিকমতো চলেনি। গবেষণায় দেখা গেছে, যে কোষে প্রোটিনের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয় বা ভেসিকলটি ছোট, সেখানে ছন্দ কেটে যায়। অর্থাৎ, “ঘড়ি” চলবে কিনা, সেটি নির্ভর করে যন্ত্রপাতির , অর্থাৎ প্রোটিনের, ঘনত্বের ওপর। তাঁরা প্রতিটি কোষকে একেকটা বিশেষ ধরনের নম্বর বসানো চাকা ধরে নিয়ে এক মডেল তৈরি করেন। সেখানে ঘড়ি ঠিকঠাক চলে কি না তা নির্ভর করছে প্রোটিন সংখ্যা কতটা পড়ে গেছে তার ওপর।
র‍্যানডম প্রটিন সংখ্যা অনুযায়ী KaiC-এর ফসফরাইলে কি ঘটছে, সেটা হিসাব করে দেখা গেল, প্রোটিন বেশি হলে ঘড়ি ঠিকঠাক চলে, কম হলে থেমে যায়। তবে আরও এক চমক আছে। সায়ানোব্যাকটেরিয়ার ঘড়ি জিন অভিব্যক্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এই জিন বর্তনী বাদ দিলে ছন্দ একদম থেমে যায় না, বরং একেক কোষ একেক ছন্দে চলে। আবার অন্য বর্তনী যোগ করলে তারা একলয়ে চলে। অর্থাৎ, জিন অভিব্যক্তি যেন এক সংগীত পরিচালক, যে ঘড়িগুলোকে এক লয়ে বাঁধে।

এই নতুন পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন ঘড়ির ভেতরের যন্ত্রাংশগুলিকে একে একে খুলে দেখতে পারবেন। এতে ক্যান্সার চিকিৎসা, ওষুধ কিংবা কৃত্রিম কোষ তৈরির ক্ষেত্রে সময়-নির্ভর প্রক্রিয়া আরও নিখুঁত করা সম্ভব হবে। ছোট্ট ফ্যাট-বুদ্বুদের ভিতরকার এই নিখুঁত জৈব ছন্দ যেন বলে, ছোট হলেও এই কৃত্রিম কোষ জানে, এখন কতটা বেলা গড়িয়েছে।

সূত্রঃ Reconstitution of circadian clock in synthetic cells reveals principles of timekeeping by Alexander Zhan Tu Li, et.al ; Nature Communication (16)(21st July, 2025).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven − three =