বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি মানুষ টিউবারকিউলোসিস বা টিবিতে আক্রান্ত হন। তার মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। শতাব্দী প্রাচীন বেসিলাস ক্যালমেট-গুয়েরিন (বিসিজি) ভ্যাকসিন এখনও শিশুদের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও, প্রাপ্তবয়স্কদের ফুসফুসের টিবি রোধে তেমন ফল দিচ্ছে না। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির (এমআইটি) একদল বিজ্ঞানী নতুন ভ্যাকসিন উন্নয়নের সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করেন। টিবি-জীবাণু মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস (Mtb)-এর হাজার হাজার প্রোটিনের মধ্যে কোনগুলো মানুষের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চিনতে পারে? অর্থাৎ, কোন প্রোটিনগুলো আসল “অ্যান্টিজেন” হিসেবে কাজ করতে পারে যা টি-সেল (রোগপ্রতিরোধক কোষ) সক্রিয় করবে- এই ছিল লক্ষ্য। এমআইটির জীববিজ্ঞান ও জৈবপ্রকৌশল বিভাগের দলটি সংক্রমিত মানব প্রতিরোধক কোষ থেকে প্রোটিন-ভিত্তিক অংশ সংগ্রহ করে সেই রহস্যের অনুসন্ধান করেছে। তারা MHC শ্রেণি–২ নামের এক ধরনের প্রদর্শক প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত জীবাণুর ক্ষুদ্র টুকরো (যেগুলো “পেপটাইড” নামে পরিচিত) আলাদা করে বিশ্লেষণ করেছেন। এই ক্ষুদ্র পেপটাইডগুলি শনাক্ত করা হয়েছে ভর-স্পেকট্রোমেট্রি বা ভরের ওপর ভিত্তি করে। এরপর সেগুলি এমন ব্যক্তিদের রক্তকোষের সামনে উপস্থাপন করা হয়, যাঁরা আগে টিবিতে সংক্রমিত ছিলেন। দেখা হয় কোন কোন পেপটাইড তাদের টি-সেলের প্রতিক্রিয়া উদ্দীপিত করতে পারে। ফলাফলে দেখা যায়, মোট ২৭টি পেপটাইড এমএইচসি প্রোটিনে আবদ্ধ হয়েছিল, যেগুলো ১৩টি পৃথক প্রোটিন থেকে উদ্ভূত। এদের মধ্যে প্রায় সবকটিই কোনো না কোনোভাবে টি-সেল প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। তবে গবেষকরা বলছেন, “আমরা এমন কোনো একক প্রোটিন পাইনি যা সবার ক্ষেত্রে কার্যকর।“ তাই একটি বহুমাত্রিক বা সমন্বিত ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হতে পারে। একাধিক অ্যান্টিজেন একসাথে ব্যবহার করে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। গবেষণায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। দেখা গেছে, টিবি-জীবাণুর টাইপ সেভেন সিক্রেশন সিস্টেম (ধরন–৭ নিঃসরণ ব্যবস্থা)-এর কিছু প্রোটিন মানুষের প্রতিরোধক কোষে বেশি হারে উপস্থাপিত হয়। বিশেষ করে ইএসএক্স–এ (EsxA) এবং ইএসএক্স–বি (EsxB) নামের দুইটি প্রোটিনের যুগল রূপ। যাকে হেটেরোডাইমার বলা হয়। ফ্যাগোসাইটিক বা গ্রাসকারী কোষের ভিতরে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণার আরেকটি উদ্ভাবনী দিক, বিজ্ঞানীরা ঐ প্রোটিনগুলির উপর ভিত্তি করে বার্তাবাহী রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (mRNA) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। এই ভ্যাকসিনে ইএসএক্স–বি ও ইএসএক্স–জি প্রোটিনের জেনেটিক নকশা যুক্ত করা হয়। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, যখন এই এমআরএনএ কোষের লাইসোসোম (অবক্ষয়কেন্দ্র) লক্ষ্য করে প্রবেশ করে, তখন পেপটাইড উপস্থাপনার হার হাজারগুণ বৃদ্ধি পায়। আরও আশ্চর্যজনকভাবে, ইএসএক্স–এ প্রোটিন যোগ করলে উপস্থাপনার মাত্রা আরও বাড়ে। এইভাবে আটটি প্রোটিনকে একত্রিত করে এমন একটি যৌগিক ভ্যাকসিন তৈরি করা যেতে পারে যা অধিকাংশ মানুষের জন্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা টিবির সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কার মানে কোটি কোটি মানুষের জন্য নতুন আশার আলো। এমআইটির দল বলছে, “আমরা এখনও মানবদেহে পরীক্ষার পর্যায়ে পৌঁছাইনি। এতে কয়েক বছর সময় লাগবে। কিন্তু দিকনির্দেশটি স্পষ্ট: টিবি-ভ্যাকসিনের ভবিষ্যৎ mRNA প্রযুক্তির মধ্য দিয়েই এগোচ্ছে।”এক শতাব্দী আগে ফরাসি বিজ্ঞানী ক্যালমেট গুয়েরিনের হাত ধরে টিবি প্রতিরোধের যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল, এমআইটির এই গবেষণা তার পরবর্তী অধ্যায় হতে পারে।
সূত্র: MIT study finds targets for a new tuberculosis vaccine; Anne Trafton; MIT News; November 5, 2025
