জীবনের সূত্রপাত ঘটে মায়ের একটি ডিম্বাণু (egg) এবং পিতার একটি শুক্রাণু (sperm) পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়া থেকে। এই মিলনে যে নতুন কোষটি তৈরি হয়, সেটিকে বলে জাইগোট (zygote)। জাইগোট বিভাজিত হয়ে ভ্রূণ (embryo) তৈরি করে এবং সেই ভ্রূণ ধীরে ধীরে বিভিন্ন টিস্যু (tissue) ও অঙ্গ (organ)-এ রূপ নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি অতি ক্ষুদ্র একটি জীব কোষ, যা খালি চোখে দেখা যায় না । জেনেটিক উপাদান সমৃদ্ধ এই কোষ পরপর বিভাজন হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে তা থেকে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন- মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, কিডনি ইত্যাদি গঠিত হয়। অবশেষে সম্পূর্ণ দেহের আকার নেয়। এই ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মধ্যে থাকে মাতা ও পিতার ২৩ টি করে ক্রোমোসোম, মিলিত ভাবে ২৩ জোড়া । ক্রোমোসোম হলো DNA দিয়ে তৈরি এক লম্বা গঠন, যা এক বিশেষ প্রোটিনকে জড়িয়ে কোষের নিউক্লিয়াসে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। প্রতিটি ক্রোমোসোমে হাজার হাজার জিন থাকে। মানুষের জিনোম বলতে বোঝায় মানুষের দেহ কোষে থাকা সমস্ত জিনগত উপাদানের পূর্ণ সেট, ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম — অর্থাৎ মানুষের সব ডিএনএ (DNA)-এর সম্পূর্ণ সংগ্রহ। এতে প্রায় ৩২০ কোটি বেস পেয়ার (base pairs) আছে। মানুষের জিনোমে প্রায় ২০,০০০–২৫,০০০ প্রোটিন-কোডিং জিন রয়েছে। নন-কোডিং ডিএনএ (Non-coding DNA) হলো সেই অংশ যা প্রোটিন তৈরির কোড বহন করে না, অর্থাৎ এই অংশ থেকে কোনো প্রোটিন তৈরি হয় না। মানুষের জিনোমের প্রায় ৯৮% অংশই নন-কোডিং, কিন্তু তা একেবারেই অকেজো নয় — বরং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণমূলক, গঠনমূলক ও বিবর্তনজনিত ভূমিকা রয়েছে। মানুষের একটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম আছে। এদের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম লিঙ্গ নির্ধারক (sex chromosome) আর বাকি গুলোকে আটোসোম বলে যা দেহের সাধারণ গঠন ও কার্য সম্পন্ন করার তথ্য মজুত থাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই নতুন মানুষটির দেহকোষে অর্ধেক মায়ের বাকি অর্ধেক পিতার ডিএনএ রয়েছে। সেই পিতা মাতার ডিএনএ বা জিনগুলির নিয়ন্ত্রণের উপরে নির্ভর করে সন্তানের বৈশিষ্ট্য কী কী হতে পারে। সাধারণত দেখা যায় পুত্র সন্তানের মধ্যে পিতার জিন গুলি মুখ্য ভূমিকায় থাকে আবার কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের। তবে এর ব্যতিক্রমও স্বাভাবিক বা মিশ্রণও স্বাভাবিক। আবার অনেক সময় পিতা বা মাতার বাবা-মায়ের উপরও নির্ভর করছে। সন্তানের এই ডিএনএ-র মধ্যে পিতা-মাতার সব তথ্য নথিভুক্ত আছে : কেমন হবে সন্তানের গায়ের রঙ, চুল কোঁকড়ানো হবে কি না, বদরাগী নাকি অমায়িক, লম্বা নাকি বেঁটে, চোখের রং কালো নাকি নীল, ইত্যাদি।
এবার আসি এই ডিএনএ কি, কত বড়, কেমন দেখতে বা এর কাজ কি ।
নিচের ছবিটিতে সবকিছু বড় করে দেখানো হয়েছে যার কোন অংশটাই খালি চোখে দেখা যায় না।
ডিএনএ (DNA, Deoxyribonucleic Acid) এর পুরো নাম ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড এটি একটি রাসায়নিক পদার্থ ।RNA হল রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। আগেই বলেছি, খালি চোখে কোষকে দেখা যায় না। উন্নত মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রের মাধ্যমে কোষের ভেতরে থাকা জিনিসগুলো দেখা যায়। আর ডিএনএ এর গঠন দেখা যায় X-ray crystallography করে বা microscope দিয়ে । ডিএনএ এত লম্বা যা আমাদের কল্পনারও অতীত। এই চুলের থেকেও অনেক অনেক সরু কিন্তু লম্বা ডিএনএ কুণ্ডলীকৃত হয়ে কোষের মধ্যে রয়েছে। যদি একটি কোষের এই ডিএনএ কে আমরা টেনে সোজা করি আর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অব্দি মেপে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে এটা প্রায় প্রায় ২ মিটার বা ৬ ফুটের বেশি দীর্ঘ। মোট কোষের সংখ্যা প্রায় ৩৭ লক্ষ কোটি, আর মানব শরীরে এর সব কোষ মিলিয়ে ডিএনএ এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৪০০ কোটি কিলোমিটার।
ডিএনএ একটি দ্বি-হেলিক্স (double helix) আকৃতির অণু। এটি তৈরি হয় চার ধরনের ক্ষুদ্র রাসায়নিক উপাদান বা নিউক্লিওটাইড (nucleotide) দিয়ে। নিউক্লিওটাইড বেস : A (Adenine), T (Thymine), G (Guanine), C (Cytosine) । এই চারটি বেস নিয়ে একটি দীর্ঘ শৃঙ্খল তৈরি হয় যেমন- ……..ATG CGT ACG TTA GCT……. । ডিএনএ একটি দ্বি-হেলিক্স (double helix)। তাহলে অন্য শৃঙ্খল টি হবে পরিপূরক (complementary)- …….. TAC GCA TGC AAT CGA……. এইবার এই দুটি শৃঙ্খল কাছাকাছি এসে জোড়া লাগে-
5′– A T G C G T A C G T T A G C T –3′
3′– T A C G C A T G C A A T C G A –5′
A সবসময় T-এর সাথে এবং G সবসময় C-এর সাথে জোড়া বাঁধে। এই দুটি শৃঙ্খল কিন্তু একটি আর একটির পরিপূরক । T এর তলায় A বা G এর তলায় C রয়েছে ।
A এর সাথে T এর দুটি আর G ও C এর মধ্যে তিনটি হাইড্রোজেন বন্ড থাকে। এই ভাবেই দুটি শৃঙ্খল তৈরি করে ডিএনএ দ্বি-হেলিক্স, ঠিক বাঁশ বা কাঠের তৈরি সিঁড়ি বা মই এর মতো। যদি মই টা কে একটু মোচড় দেওয়া যায় তাহলে যেমন দেখতে হবে তেমনই হয় ডিএনএ এর গঠন। ডিএনএ কে একটি পাকানো সিঁড়ির মতো ধরা যেতে পারে।
এখানে জেনে রাখা ভালো যে আরএনএ (RNA) এর ক্ষেত্রে T এর জায়গার U (uracil) থাকে । মানুষের পুরো জিনোমে এই বেস এর সংখ্যা প্রায় ৩২০০ কোটি । এই চার অক্ষরের ধারাবাহিক বিন্যাসই হলো ডিএনএ পর্যায়ক্রম বা সিকোয়েন্স (DNA sequence)।
উদাহরণ: একটি ডিএনএ অংশের ছোট সিকোয়েন্স হতে পারে ……..ATG CGT ACG TTA GCT……. এই অক্ষরগুলোর বিন্যাসই নির্ধারণ করে কোন জিন কী ধরনের প্রোটিন তৈরি করবে। অর্থাৎ, ডিএনএ সিকোয়েন্স হলো জীবের জিনগত নির্দেশাবলী (genetic instructions)।
ডিএনএ থেকে mRNA (transcription), mRNA থেকে প্রোটিন (translation) তৈরি হয়; এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় Central Dogma of Molecular Biology (আণবিক জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় নীতি) Transcription (ট্রান্সক্রিপশন), নিউক্লিয়াসের ভেতর ডিএনএ-এর নির্দিষ্ট অংশ (একটি জিন, উদাহরণ হিসেবে মাত্র কয়েকটি বেস নেওয়া হয়েছে) …….TAC GCT AAG T….. থেকে একটি অনুলিপি তৈরি হয় — যেটি হলো mRNA (messenger RNA)।
mRNA sequence (complementary) → …….AUG CGA UUC A…
(এখানে A→U, T→A, G→C, C→G)
এর পরের কাজ কে বলা হয় Translation (ট্রান্সলেশন), কাজটি হয় রাইবোজোমে।
উদাহরণ: mRNA-এর তিনটি বেস মিলে একটি কোডন (codon) →……AUG | CGA | UUC | A… প্রতিটি কোডন একটি নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিডকে নির্দেশ করে (কোডন চার্ট দেওয়া হয়েছে, যেখানে দেখা যায় বিভিন্ন কোডন থেকে একটি নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া যায়)। যেমন —
AUG → Methionine, Met (শুরুর সংকেত)
CGA → Arginine, Arg । এই অ্যামিনো অ্যাসিড আরও ৫ টি কোডন থেকে তৈরি হতে পারে ।
UUC → Phenylalanine, Phe । এটিও আর ১ টি কোডন থেকে পাওয়া যায় ।
আবার UAA, UAG, UGA কোডন গুলি Stop কোডন, মানে এখানেই প্রোটিন তৈরি বন্ধ হয়ে যাবে যদি mRNA সিকোয়েন্সে এই কোডন আসে।
Translation or Protein Synthesis
এই স্থানে tRNA বা Transfer RNA আসে, প্রতিটি tRNA তে মাত্র তিনটি বেস থাকে, tRNA-র নীচে থাকে anticodon (যেটা mRNA-র কোডনের বিপরীত), এবং একটি নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। উদাহরণ: যদি mRNA-র কোডন হয় AUG, তাহলে tRNA-র anticodon হবে UAC, আর সে নিয়ে আসবে amino acid Methionine। mRNA-এর কোড অনুযায়ী এক একটি tRNA এক এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে আসে আর তা জোড়া লাগিয়ে একটা অ্যামিনো অ্যাসিড এর চেইন তৈরি হয় রাইবোজোমে যাকে বলে polypeptide chain। যখন সব কোডন পড়া শেষ হয়, সম্পূর্ণ চেইনটি নিজে নিজে ভাঁজ হয়ে একটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে — এটাই প্রোটিন।
এইভাবে কোডনগুলির ধারাবাহিকতা প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড বিন্যাস নির্ধারণ করে।
ডিএনএ যেমন চারটি উপাদান থেকে তৈরি হয়, তেমনি প্রোটিন তৈরি হয় ২০ টি বিভিন্ন ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে। প্রোটিন টা কত বড় বা ছোট তা বোঝা যায় এতে কতগুলো অ্যামিনো অ্যাসিড আছে তার হিসেব করে। ধরা যাক একটি প্রোটিনে ১৫০ টি অ্যামিনো অ্যাসিড পরপর জুড়ে শৃঙ্খল বেঁধে রয়েছে। mRNA এর তিনটি বেস নিয়ে একটি কোডন, আর একটি কোডন থেকে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড। তাহলে প্রোটিনটি তৈরি করতে যে mRNA ব্যবহার করা হয়েছে তাতে ৪৫০ টি বেস রয়েছে, অর্থাৎ কিনা যে ডিএনএ জিনটি থেকে এই নির্দিষ্ট প্রোটিন পাওয়া যায় তাতে ৪৫০ টি ATGC রয়েছে একটি শৃঙ্খলে। যেহেতু ডিএনএ দ্বি হেলিক্স তাই এই জিনে ৯০০ টি বেস আছে বা ৪৫০ টি বেস পেয়ার রয়েছে।
ডিএনএ
জীবের বংশগত তথ্য সংরক্ষণ করে, প্রোটিন তৈরি করার নির্দেশ দেয়, আর এই প্রোটিন আমাদের শরীর গঠন করে আর দেহের সকল কাজকর্ম করে। ডিএনএ কোষ বিভাজনের সময় নিজের অনুলিপি (replicate) তৈরি করে বংশগত বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তর করে।
