দশ হাজার নৃত্যরত শিব

দশ হাজার নৃত্যরত শিব

প্রদীপ্ত গুপ্তরায়
অধ্যক্ষ, দমদম মতিঝিল কলেজ, কোলকাতা
Posted on ২০ এপ্রিল, ২০২৫

ছাব্বিশ শতক আগে বসবাস করা গ্রীক দার্শনিক এনক্সিমান্ডার (Anaximander) বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাকাশে পৃথিবী কোনকিছুর সাহায্য ছাড়াই ভেসে আছে। আমরা এনক্সিমান্ডারের এই ধারনার কথা অন্যান্য লেখকের লেখা থেকে জানাতে পারি। কেবলমাত্র একটা ছোট মূল অংশ টিকে আছেঃ প্রয়োজন মত বস্তু এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হয় এবং পরস্পরের প্রতি সময়ের ক্রম অনুযায়ী সুবিচার করে।

‘সময়ের ক্রম অনুযায়ী (According to the order of time)’ – এইরকম এক অস্পষ্ট, রহস্যময় শব্দবন্ধ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের প্রাথমিক, গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় – সময়ের ক্রমকেই আহ্বান জানায়।

এনক্সিমান্ডারের এই মন্তব্যের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান সময়ের ক্রমকে হাতিয়ার করে বিকশিত হয়েছে। প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানে তারাদের, সময়ের সাথে গতিবিধির কথা বর্ণনা করা হোত। পদার্থবিদ্যার সমীকরণে বস্তু কিভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় সেটা দেখা হয়। নিউটনের সমীকরণ — যা বলবিদ্যার ভিত্তিস্বরূপ, ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ, শ্রডিঙ্গার সমীকরণ – যেটা কিভাবে কোয়ান্টাম ঘটনার কারন নির্দেশ করে, বা আন্তঃ আণবিক গতিবিদ্যা – যা কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়, পদার্থবিদ্যার সব ক্ষেত্র এবং সাধারনভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রই সময়ের ক্রম ধরেই বিকশিত হয়েছে।

সমীকরণের মধ্যে সময়কে t দিয়ে সূচিত করা আমাদের দীর্ঘদিনের রীতি। এই t কি নির্দেশ করে? এটা ঘড়ির সাহায্যে মাপা একটা সংখ্যাকে নির্দেশ করে। বস্তু কিভাবে কোন এক ঘড়ির সাহায্যে মাপা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় সমীকরণগুলো সেই কথা বলে।

আমরা আগে যে কথাটা বলেছিলাম, বিভিন্ন ঘড়ি যখন বিভিন্ন সময় দেয় তাহলে t কোন সময়টা নির্দেশ করবে? পাহাড়ে থাকা এবং সমুদ্রতলে থাকা দুই বন্ধু যখন আবার পরস্পরের সাথে মিলিত হবে, তখন দুই বন্ধুর ঘড়ি বিভিন্ন সময় দেখাবে। কার t  নেওয়া হবে? পদার্থবিদ্যা গবেষণাগারে টেবিলে থাকা এবং মাটিতে থাকা ঘড়ি বিভিন্ন সময় দেয়। এই দুটোর কোনটি সময়ের কথা বলবে? এই দুই সময়ের মাঝের তফাৎ আমরা কিভাবে বর্ণনা করব? আমরা কি বলব, মাটিতে থাকা ঘড়িটি, টেবিলের ওপরে থাকা প্রকৃত সময় নথিভুক্ত করা ঘড়িটির চাইতে আস্তে চলছে? অথবা, টেবিলের ঘড়িটি, প্রকৃত সময় নথিভুক্ত করা মাটিতে থাকা ঘড়িটির চাইতে দ্রুত চলছে?

এই প্রশ্নটার কোন অর্থ হয় না। টাকা ও পয়সার মধ্যে কোনটা বেশি বাস্তব – এই বাক্যের যেমন কোন অর্থ নেই, ঠিক সেইরকমই, কোন ‘বেশি সত্য’ সময়ের অস্তিত্ব নেই। এই দুটো সময় একে অন্যের সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয়। কোনটাই একে অন্যের চাইতে বেশি সত্য না।

কিন্তু কেবলমাত্র দুটো সময়ই যে আছে তা নয়। সময় বিপুল সংখ্যায় আছে। প্রতিটি স্থানিক বিন্দুতে ভিন্ন সময় অবস্থান করে। কোন একক সময়ের অস্তিত্ব নেই। এক বিরাট সময়ের সমাহার।

কোন একটা ঘটনার সময় আমরা যখন কোন এক নির্দিষ্ট ঘড়ি দিয়ে মাপি, সেই সময়কে আমরা পদার্থবিদ্যার ভাষায় ‘যথাযথ সময় (Proper time)’ বলতে পারি। প্রত্যেকটা ঘড়িরই তার নিজস্ব যথাযথ সময় আছে। প্রত্যেকটা ঘটনারই যথাযথ সময় আছে, তার নিজস্ব ছন্দ আছে।

আইনস্টাইন যে সমীকরণ দিয়েছেন, তাতে পরস্পরের সাপেক্ষে যথাযথ সময় কিভাবে বিকশিত করা যায়, তার বর্ণনা আছে। দুটো সময়ের মাঝে তফাৎ কিভাবে গণনা করা যায় সেটা তিনি দেখিয়েছেন।

একক রাশি ‘সময়’ কেমন যেন মাকড়শার জালের মতো বিস্তৃত হয়ে গেছে। সময়ের সাথে কিভাবে পৃথিবীর উদ্ভব হোল, তা আমরা বলতে পারবনা। বরং বস্তু কিভাবে স্থানীয় সময়ে উদ্ভব হয়েছে সেটা বলতে পারব। আর প্রত্যেকের সাপেক্ষে কিভাবে স্থানীয় সময় উদ্ভব হয়েছে, সেটা বলতে পারব। একজন কম্যান্ডারের নির্দেশে এক সৈন্যদল এগিয়ে যাচ্ছে – পৃথিবী এইরকম না। বলা যেতে পারে, বিভিন্ন ঘটনার একটা নেটওয়ার্ক – যা পরস্পরকে প্রভাবিত করছে।

আইনস্টাইনের সাধারন পদার্থবিদ্যায় একক ‘সময়’ বলে কিছু নেই বরঞ্চ সেখানে অগুন্তি সময় রয়েছে। দুটো ঘটনার মাঝে, যে পৃথক দুটো ঘড়ি কাজ করছে, তাদের যখন কাছাকাছি আনা হয়, সময়কাল কিন্তু এক হবেনা। পদার্থবিদ্যা কখনই সময়ের সাথে বস্তু কিভাবে উৎপন্ন হয় –সেটা কখনই বর্ণনা করে না, কিন্তু বস্তু কিভাবে নিজের সময়ে বিকশিত হয় এবং প্রত্যেকের সাপেক্ষে সময় কিভাবে অভিব্যক্ত হয় তার কথা বলে।

একক সময়ের ধারনাটা আর থাকছে না। প্রত্যেক জায়গায় এর বিভিন্ন ছন্দ আছে এবং ওখান থেকে এখানে ভিন্নভাবে অতিবাহিত হয়। এই পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তু যেন বিভিন্ন তালে নেচে যাচ্ছে। যদি নৃত্যরত শিবের কথা ভাবি, তাহলে প্রায় দশ হাজার শিব ক্রমাগত নেচে চলেছেন ……………।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight + 18 =