কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের টুরকানা হ্রদের কাছে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন প্রায় ১৫ লক্ষ বছরের পুরনো কিছু পদচিহ্ন, যা প্রমাণ দিচ্ছে, হোমো ইরেকটাস এবং প্যারানথ্রোপাস বোইসি নামের দুটি বিলুপ্ত প্রজাতি একসময় পাশাপাশি বাস করত। এই পদচিহ্নগুলোর অবস্থান “টিএস-২” (TS-2) নামে একটি প্রাচীন স্তরে। স্তরটি আগ্নেয় ছাই এবং সূক্ষ্ম বালির মিশ্রণে তৈরি। গবেষকরা জানিয়েছেন, এই স্তরটির বয়স প্রায় ১.৫২ কোটি বছর। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিহাসে মধ্য-প্লাইস্টোসিন যুগের সময়কাল। সেসময় এই চিহ্ন যখন তৈরি হয়েছিল, তার অল্প পরেই বালির আস্তরণে সেগুলি ঢেকে যায়। ফলে আজও সেই পায়ের ছাপগুলি অবিকল সংরক্ষিত রয়েছে, যেন সময় নিজেই সেগুলিকে রক্ষা করেছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, আফ্রিকায় প্রাচীন মানবগোষ্ঠীগুলো একাধিক প্রজাতি হিসেবে একসাথে বাস করত। কিন্তু সেই তত্ত্বের সরাসরি প্রমাণ খুবই বিরল।এই পায়ের চিহ্নই প্রথম সুনির্দিষ্ট প্রমাণ, যা বলছে, দুই আলাদা প্রজাতি একই জায়গায় একই সময়ে হেঁটেছিল। এই স্তরে একটানা একটি পায়ের ছাপের সারি (যাকে বলা হয় “ট্র্যাকওয়ে”) এবং আরও তিনটি বিচ্ছিন্ন পায়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আশেপাশে পাখি, গরু ও অন্যান্য প্রাণীর পায়ের ছাপও দেখা গেছে। যা ইঙ্গিত দেয়, এটি ছিল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এক প্রাচীন হ্রদতীর অঞ্চল। পদচিহ্ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দুই প্রজাতির চলনশৈলী আলাদা করে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। হোমো ইরেকটাস-এর পায়ের ছাপ আধুনিক মানুষের মতো। সোজা হাঁটা, দীর্ঘ পদক্ষেপ, শরীরের ভারসাম্য স্পষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত। এটি নির্দেশ করে, তারা দূরপথে হেঁটে চলার অভ্যেসযুক্ত ছিল। অন্যদিকে, প্যারানথ্রোপাস বোইসি-র ছাপগুলি তুলনামূলকভাবে গভীর, পায়ের পাতা প্রশস্ত এবং আঙুলের ছাপ ভারী। এটাই তাদের শক্তপোক্ত দেহগঠনের ইঙ্গিত দেয়। তারা সম্ভবত ধীর গতির চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিল, এবং ঘন উদ্ভিদময় অঞ্চলে খাদ্য সংগ্রহে দক্ষ ছিল। এই পার্থক্যগুলো শুধু প্রজাতির দেহগঠনই নয়, তাদের জীবনযাপন ও পরিবেশ অভিযোজনের কাহিনীও বলে। হ্রদের ধারে ছিল প্রচুর জল, ফল, পাতা, এবং শিকারযোগ্য প্রাণী। এটাই উভয় প্রজাতির জন্য আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল। গবেষকরা মনে করছেন, তারা হয়তো সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, আবার কখনও হয়তো পরস্পরকে এড়িয়ে চলত। একই পরিবেশে একাধিক হোমিনিন (মানবজাতীয় প্রাণী) প্রজাতির সহাবস্থান, আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসে নতুন আলো ফেলেছে। এটি প্রমাণ করছে যে মানববিবর্তন ছিল না কোনো সরল সিঁড়ির মতো পথ—বরং একসাথে চলা, মিলেমিশে থাকা এবং একে অপরের সঙ্গে অভিযোজিত হওয়ার জটিল জাল।পদচিহ্নগুলো বিশ্লেষণ করতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন উচ্চ-নির্ভুল ত্রিমাত্রিক স্ক্যানিং প্রযুক্তি।এতে দেখা গেছে, হাঁটার কোণ, পায়ের চাপ এবং গতিবেগ নির্ণয় করে বোঝা সম্ভব হয়েছে কে কোন প্রজাতির ছিল। এছাড়া আগ্নেয় ছাইয়ের স্তর বিশ্লেষণ করে সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এই পদচিহ্নগুলোর বয়স নির্ভুলভাবে নির্ধারণে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারকে বলছেন “ট্রেস ফসিল”। অর্থাৎ জীবের উপস্থিতির পরোক্ষ প্রমাণ, যা আমাদের বলে দেয় তারা কীভাবে চলত, কোথায় যেত,কার সঙ্গে থাকত। গবেষণাটি শুধু দুটি প্রজাতির সহাবস্থানের প্রমাণই দেয়নি; এটি মানববিবর্তনের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে নতুন প্রশ্নও তুলেছে। হয়তো এই দুই প্রজাতি কখনও খাদ্য ও স্থান ভাগ করেছে, আবার হয়তো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ম্যাথিউ বেনেট বলেন, “এই পদচিহ্নগুলো এমন এক মুহূর্তকে ধরে রেখেছে, যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা একসাথে হেঁটেছিলেন — এ যেন পাথরের নীচে লুকিয়ে থাকা এক ফ্রেমের ছবি।“এই পদচিহ্ন কেবল মাটিতে থাকা ছাপ নয়। এটি মানবতার প্রাচীন পদক্ষেপের প্রতিধ্বনি। যা জানিয়ে দেয়, আমরা একা নই; আমরা বহু পথিকের উত্তরসূরি।
সূত্র : Footprint evidence for locomotor diversity and shared habitats among early Pleistocene hominins by Kevin G Hatala; et.el; Science 28 Nov 2024; Vol 386, Issue 6725
