নদী-জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত এলাকার উপযোগিতা

নদী-জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংরক্ষিত এলাকার উপযোগিতা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

জীববৈচিত্র্য সংকট আজ বিশ্বের বাস্তবতা। এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণকে একটি প্রধান কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। ৩০ শতাংশ এলাকা ২০৩০ সালের মধ্যে সংরক্ষণের আওতায় আনার এই লক্ষ্য আজ আন্তর্জাতিক নীতির কেন্দ্রে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সংরক্ষণ কি সব বাস্তুতন্ত্রের জন্য সমানভাবে কার্যকর? নেচার কমিউনিকেশন্স (২০২৫)–এ প্রকাশিত এক বিস্তৃত ইউরোপীয় গবেষণা দেখাচ্ছে, নদী ও মিষ্টি জলের জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে উত্তরটি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। ইউরোপের নদী ও মিষ্টি জলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বর্তমান সংরক্ষিত এলাকাগুলোর কার্যকারিতা বেশ সীমিত। এই গবেষণায় ইউরোপের ১০টি দেশের ১,৭৫৪টি নদীস্থলের প্রায় চার দশকের (১৯৮৬–২০২২) উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নদীর অমেরুদণ্ডী প্রাণী, যেমন – কীটপতঙ্গের লার্ভা, শামুক ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী। যারা জলজ খাদ্যজাল, পুষ্টিচক্র এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূচক।

উপাত্ত বিশ্লেষণে তিনটি সূচক ব্যবহৃত হয়েছে: প্রাণীর মোট সংখ্যা, প্রজাতির সংখ্যা এবং বাস্তুতন্ত্রের গুণগত অনুপাত (ই কিউ আর )—যা মানবসৃষ্ট চাপের মাত্রা নির্দেশ করে।

গবেষণার মূল ফলাফল হিসেবে সামগ্রিকভাবে দেখা গেছে, সংরক্ষিত এলাকা থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নদীর জীববৈচিত্র্যের উন্নতিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অধিকাংশ নদীতেই সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত অবস্থায় জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তনের হার প্রায় সমান। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সংরক্ষিত এলাকার বাইরে থাকা নদীগুলোর পরিবেশগত মান তুলনামূলকভাবে দ্রুত উন্নত হয়েছে—যা প্রচলিত ধারণার বিপরীত।

তবে এই চিত্রের ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম রয়েছে। যেসব নদীর অবস্থা শুরুতেই খুব খারাপ ছিল (অর্থাৎ কম ই কিউ আর) এবং যাদের উজানের বড় অংশ সংরক্ষিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত, সেসব নদীতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশগত গুণমানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে। বিশেষত পুরো জলাধার জুড়ে সংরক্ষণ বাড়লে নদীর পরিবেশগত পুনরুদ্ধার অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। বিপরীতে, কেবল নদীর আশপাশের ছোট পরিসরের সংরক্ষণ, প্রজাতির সংখ্যা কিছুটা বাড়ালেও নদীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে তা যথেষ্ট নয়।

এই গবেষণা স্পষ্টভাবে দেখায়, ইউরোপের অধিকাংশ সংরক্ষিত এলাকার নকশা মূলত স্থলভাগের বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণীদের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে, নদী ও মিষ্টি জলের বিশেষ চাহিদা সেখানে উপেক্ষিত। নদীকে একটি বিচ্ছিন্ন স্থান হিসেবে দেখা হয়েছে, অথচ নদী আসলে একটি সংযুক্ত ব্যবস্থা—উজানের ভূমি ব্যবহার, দূষণ ও জলপ্রবাহ নীচের অংশের জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে। তাই ছোট ও বিচ্ছিন্ন সংরক্ষিত এলাকা নদীর জন্য কার্যকর সুরক্ষা দিতে পারে না।

গবেষকদের তরফ থেকে উপসংহার হলো—নদীজীববৈচিত্র্য রক্ষায় জলাধারভিত্তিক সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, বড় ও ধারাবাহিক সংরক্ষিত এলাকা, এবং দূষণ ও অন্যান্য চাপ মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি। নদীকে বাঁচানো মানে শুধু জলজ প্রাণী নয়, স্থলভাগ ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রকেও রক্ষা করা। আর সেই পথেই হয়তো বিশ্বের জীববৈচিত্র্য হ্রাসের গতিপথ বদলানো সম্ভব।

 

সূত্র: Current protected areas provide limited benefits for European river biodiversity by James S. Sinclair, Aitor Larrañaga, et.al; published in nature communications , 17th December 2025.

https://doi.org/10.6084/m9.figshare.25245430.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − ten =