মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালা। তার অনেক নীচে, ভূগর্ভের গভীরে এক বিশাল উষ্ণ শিলাস্তূপ নিয়ে নতুন তথ্য পেয়েছেন সাদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁদের মতে, এই গরম শিলার উৎপত্তি ৮ কোটি বছর আগে গ্রিনল্যান্ড ও উত্তর আমেরিকার বিচ্ছেদের সময়ে। এটি শিলাটির বর্তমান অবস্থানের থেকে প্রায় ১,৮০০ কিলোমিটার দূরে তৈরি হয়েছিল। এতদিন ধারণা ছিল, এই তাপীয় অঞ্চলটি ১৮ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকা ও উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা আলাদা হওয়ার সময়কার পুরনো অবশিষ্ট। কিন্তু নতুন গবেষণা এই ধারণাকে বদলে দিচ্ছে। ‘নর্দার্ন অ্যাপালাচিয়ান অ্যানোমালি’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি প্রায় ৩৫০ কিমি বিস্তৃত। নিউ ইংল্যান্ডের নীচে ২০০ কিমি গভীরেও এর অবস্থান রয়েছে। এটি লাব্রাডর সাগরের কাছে গঠিত হয়েছিল, যখন গ্রিনল্যান্ড ও কানাডার ভূত্বক পৃথক হতে শুরু করে। এরপর এটি ধীরে ধীরে, প্রতি কোটি বছরে প্রায় ২০ কিলোমিটার করে সরে আসতে আসতে বর্তমান স্থানে পৌঁছায়।
গবেষণা-প্রধান অধ্যাপক টম গারনন জানান, অ্যাপালাচিয়ান অঞ্চল বহু কোটি বছর ধরে টেকটনিকভাবে স্থির। তাই এই তাপীয় বৈশিষ্ট্যকে শুধু পুরনো বিচ্ছেদের অবশিষ্ট ভাবা যুক্তিযুক্ত ছিল না। নতুন ব্যাখ্যা বলছে, ভূগর্ভের গভীরে ধীরগতির একটি প্রক্রিয়া এখনও সক্রিয়, যা মহাদেশের শিকড় দুর্বল করে ভূখণ্ডকে হালকা ও ভাসমান বানায়। তাঁর ভাষায়, “এ যেন ভার কমানো গরম হাওয়ার বেলুনের মতন”। এই প্রক্রিয়া হয়তো অ্যাপালাচিয়ান পর্বতকে সাম্প্রতিক সময়ে আরও উঁচু হতে সাহায্য করেছে।
গবেষক দল তাঁদের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেছেন ‘ম্যান্টল ওয়েভ’ তত্ত্ব, যা ২০২৪ সালের ‘ব্রেকথ্রু অফ দ্য ইয়ার’-এর চূড়ান্ত তালিকায় ছিল। তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাদেশ ভাঙার পর উত্তপ্ত, ঘন শিলা প্লেটের তলা থেকে ধীরে ধীরে আলগা হয়ে লাভা ল্যাম্পের ফোয়ারার মতো উপরে-নীচে চলাচল করে। এই ঢেউ–জাতীয় প্রক্রিয়া লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মহাদেশের নীচে অগ্রসর হয়ে ভিতরের অংশে উচ্চভূমি সৃষ্টি, অস্বাভাবিক আগ্নেয়গিরি কার্যকলাপ এবং এমনকি হীরাবাহী উদগিরণের কারণ হতে পারে। এই ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গবেষকেরা ব্যবহার করেছেন, জিওডাইনামিক কম্পিউটার মডেলিং, সিসমিক টোমোগ্রাফি, প্রাচীন প্লেট চলাচলের পুনর্গঠন তত। এসব তথ্য একত্র করে দেখা যায়, নর্দার্ন অ্যাপালাচিয়ান অ্যানোমালি সম্ভবত ৯–৮ কোটি বছর আগে লাব্রাডর সাগর খোলা শুরু হওয়ার সময়ই জন্ম নেয়।
GFZ–এর ভূ-গতিশাস্ত্রবিদ অধ্যাপক সাশা ব্রুনে বলেন, ভূগর্ভে কয়েক কিলোমিটার পুরু শিলা-খণ্ড বা “ড্রিপ” প্লেটের তলা থেকে ধীরে নেমে যায়। ফলে নীচ থেকে গরম ম্যান্টল উঠে এসে তাপীয় অঞ্চল তৈরি করে। এ ধরনের ড্রিপ একটির পর একটি তৈরি হয়ে ডোমিনোর মতো সরে যেতে পারে। নিউ ইংল্যান্ডের নীচের অ্যানোমালিটি সম্ভবত এমনই এক ড্রিপ, যা বহু দূর অগ্রসর হয়েছে। গবেষক দলের হিসাব অনুযায়ী, এই তাপীয় অঞ্চল এখনও দক্ষিণ-পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রতি কোটি বছরে ২০ কিমি গতিতে। প্রায় ১.৫ কোটি বছর পর, এটি নিউ ইয়র্কের নিচে পৌঁছাতে পারে। একই সঙ্গে গ্রিনল্যান্ডের উত্তর-মধ্য অঞ্চলের নীচেও অনুরূপ এক তাপীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সম্ভবত একই উৎসের ‘যমজ’ অ্যানোমালি। এই গভীর তাপ গ্রিনল্যান্ডের বরফস্তরের নীচে তাপমাত্রা বাড়িয়ে বরফের গলন ও প্রবাহের আচরণ বদলে দিচ্ছে। গবেষণা পত্রের আরেক সহ-লেখক ড. ডেরেক কেয়ার বলেন, “মহাদেশ ভাঙার ফলে তৈরি গরম শিলার ড্রিপ হাজার হাজার কিলোমিটার ভেতরে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ তথ্য আমাদের মহাদেশের প্রান্ত সম্পর্কে ধারণা পালটাবে।”
সূত্র : Thomas M. Gernon, Sascha Brune, Thea K. Hincks, Derek Keir. A viable Labrador Sea rifting origin of the Northern Appalachian and related seismic anomalies. Geology, 2025
