
ন্যানোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের অতি সূক্ষ্ম কণা এক গুরতর সমস্যা। হাওয়ায়, জলে, মাটিতে, এমনকি আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে এটি ঢুকে পরেছে। এই কণাগুলি এতটাই ক্ষুদ্র যে অনায়াসে সেগুলি ব্যাকটেরিয়ার গায়েও সেঁটে থাকতে পারে, এমনকি শাকসবজির শিকড়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। ফলত শেষমেশ পৌঁছে যায় আমাদের শরীরের কোষে। এগুলির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে। তবে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এবিষয়ে এক রুদ্ধশ্বাস তথ্য উন্মোচন করলেন। কিছু ন্যানোপ্লাস্টিক খাদ্যজনিত রোগজীবাণুকে আরও মারাত্মক করে তুলতে পারে। বিশেষ করে তারা নজর দিয়েছেন ইকোলাই জীবাণুর প্রকার E. coli O157\:H7-এর ওপর। এই প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব প্রতিনিয়ত খাদ্য বিষক্রিয়ার ঘটনার কেন্দ্রে থাকে। প্রধান গবেষক অধ্যাপক রাজশ্রী ব্যানার্জি এবং তার দল দেখান, ধনাত্মক চার্জযুক্ত ন্যানোপ্লাস্টিক ই-কোলাইকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। ফলে শিগা-সদৃশ ( একটি বিষাক্ত প্রোটিন) প্রাণঘাতী অধিবিষ ছড়িয়ে দেয় শরীরে। “চাপগ্রস্ত ব্যাকটেরিয়া একধরনের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামে। যেমন একটি কোণঠাসা জানোয়ার, প্রাণ বাঁচাতে আত্মরক্ষার জন্য কামড় বসায় , তেমনি ব্যাকটেরিয়া তার বিষাস্ত্র শাণিয়ে নেয়।” গবেষণায় তারা পলিস্টাইরিন (সস্তা, বহুল ব্যবহৃত ফোম-ধরনের প্লাস্টিক) থেকে তৈরি ন্যানোপ্লাস্টিক বিভিন্ন চার্জ বা শক্তি প্রস্তুত করে – ধনাত্মক, নিরপেক্ষ ও ঋণাত্মক। দেখা যায়, ধনাত্মক কণাগুলি ব্যাকটেরিয়ার ওপর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব ফেলে। এরা শুধু বিষাক্ত পদার্থ বাড়ায় না, বরং ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধির হার ধীর করে দেয়। তাদের জৈবফিল্ম বা সুরক্ষাকবচ গঠনের গতিকে বদলে দেয়। বলা যায়, একটা পরিপূর্ণ বসতি গঠনে বাধা তৈরি করে। তবু ব্যাকটেরিয়া হাল ছাড়ে না। ধীরে ধীরে, তারা আবার গড়ে তোলে নিজেদের দুর্গ। এই সুরক্ষাকবচ একটা জৈবিক বর্মের মতো, যা ব্যাকটেরিয়াকে বাইরের শত্রুর (এক্ষেত্রে ন্যানোপ্লাস্টিকের) আক্রমণ থেকে আংশিক সুরক্ষা দেয়। তবে এখানেই শেষ নয়। গবেষক দল যখন এই জৈবফিল্মে আচ্ছাদিত ই-কোলাইয়ের উপর আবারও ধনাত্মক ন্যানোপ্লাস্টিক প্রয়োগ করেন, দেখা যায়,ব্যাকটেরিয়া আরো বেশি বিষাক্ত অধিবিষ জাতীয় পদার্থ উৎপাদন করছে। “জৈবফিল্ম ব্যাকটেরিয়ার অস্ত্রাগার। এগুলি অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়াগুলির স্থায়িত্ব বাড়ায় না, উপরন্তু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক ক্ষমতা ও তাদের পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে।” গবেষণাটি শুধু ই -কোলাইএর মধ্যে সীমিত নয়। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলি থেকে জানা যায় মাইক্রো এবং ন্যানোপ্লাস্টিকের পৃষ্ঠে জৈবফিল্মগুলি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন বিনিময়ের মোক্ষম জায়গা হয়ে উঠছে যা ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এক ধরনের জিনগত ষড়যন্ত্রের মঞ্চ তৈরি করছে। এ এক অদৃশ্য অস্ত্রবাজি, যেখানে প্লাস্টিক, ব্যাকটেরিয়া আর অন্যান্য চেনা জীবাণুরা আমাদের খাদ্যতালিকার অদৃশ্য শত্রু হয়ে উঠছে।বর্তমানে এই গবেষণা আরও গভীরে গিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। মাটি ও খাদ্যে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য প্রধান রোগজীবাণু কীভাবে ন্যানোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিতে জিনগত রূপান্তর বা ভাইরাস সংক্রমণে প্রবণ হয়ে পড়ে, সেটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।আমরা হয়তো আজ প্লাস্টিকের দামি প্যাকেজিংয়ে স্বস্তি খুঁজি, কিন্তু আগামীতে এই প্লাস্টিকই আমাদের শরীরে তৈরি করবে অপ্রতিরোধ্য ব্যাকটেরিয়ার সাম্রাজ্য।