ন্যাভিয়ার-স্টোকস এমনই একটি সমীকরণ যা ছাড়া তরলগতিবিদ্যার প্রায় কোনো গবেষণাই করা যায় না। ২০০০ সালে ক্লে ম্যাথমেটিক্স ইনস্টিটিউট গণিতের সাতটি সমস্যার সমাধানের কথা বলেছে যার মধ্যে একটি আমাদের বাসযোগ্য ভৌত জগতকে বোঝার সঙ্গে মৌলিকভাবে সম্পৃক্ত। সেটি এমন এক গাণিতিক তত্ত্ব গড়ে তুলবে যা ত্রিমাত্রিক ন্যাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণের অস্তিত্ব এবং অনন্যতা সমস্যা সমাধানে সক্ষম হবে।
এই সমস্যার সমাধান তরল পদার্থের আচরণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা গঠনের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে, যে-প্রভাব প্রকৃতিতে সর্বব্যাপী। এই সমীকরণকে আমরা আবহাওয়া, সমুদ্রের স্রোত, একটি পাইপে জলের প্রবাহ এবং বিমানের একটি ডানার চারপাশে বায়ুপ্রবাহের মডেল নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। সম্পূর্ণ এবং সরলীকৃত আকারে ন্যাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণগুলি বিমান এবং গাড়ির নকশা, রক্ত প্রবাহ বিষয়ক চর্চা, পাওয়ার স্টেশনগুলির নকশা , দূষণের বিশ্লেষণ এবং আরও অনেক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের সমীকরণের সাথে মিলিত হয়ে এগুলি ম্যাগনেটোহাইড্রোডাইনামিক্স-র সমস্যা অধ্যয়নের কাজেও ব্যবহৃত হয়।
ক্লদ-লুই ন্যাভিয়ার (১০ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৫ – ২১ আগস্ট ১৮৩৬) ছিলেন একজন ফরাসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও গণিতজ্ঞ। অপরদিকে স্যর জর্জ গ্যাব্রিয়েল স্টোকস (১৩ আগস্ট ১৮১৯ – ০১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৩) ছিলেন একজন আইরিশ গণিতবিদ এবং পদার্থবিদ। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ন্যাভিয়ারেরই গবেষণার বিষয় ছিল। ১৮২২ সালে প্রকাশিত সমীকরণটি কশি-ন্যাভিয়ের সমীকরণ (Cauchy-Navier Equation) নামে পরিচিত হয়। পরবর্তী দুদশক ধরে স্টোকস-এর গাণিতিক দক্ষতায় এই সমীকরণটি আরো সাধারণীকরণের (generalization) পথে অগ্রসর হয়, তখন এর নাম হয় ন্যাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণ (Navier-Stokes Equation) । এই সমীকরণগুলি একটি চলমান তরলের বেগ, চাপ, তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত তা বর্ণনা করে। এই সমীকরণগুলি অয়লার সমীকরণের প্রসারণ। প্রবাহের উপর সান্দ্রতার প্রভাব এর অন্তর্ভুক্ত। অয়লারের সমীকরণটি মূলত Inviscid (যেখানে সান্দ্রতা কাজ করে না) প্রবাহ বোঝানোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানে আমরা যে বারনাউলির উপপাদ্য পড়ে থাকি তা এই Euler Equation for Inviscid flow থেকে উদ্ভূত। এই সমীকরণটি গাণিতিকভাবে আংশিক ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণের (Partial Differential Equation) গোত্রে পড়ে। সমীকরণের সমাধান হল একটি প্রবাহ বেগ । এটি একটি ভেক্টর ক্ষেত্র (Vector field) —একটি তরলের প্রতিটি বিন্দুতে, সময়ের ব্যবধানে যেকোনো মুহূর্তে, এটি এমন একটি ভেক্টর দেয় যার দিক এবং মাত্রা দেশ-পরিসরের (স্পেসের) সেই বিন্দুতে এবং সময়ের সেই মুহূর্তে তরলের গতিবেগের সমান হয়। এটিকে সাধারণত তিনটি স্থানিক মাত্রা এবং একটি সময়ের মাত্রায় অধ্যয়ন করা হয়। তবে দুটি (স্থান) মাত্রিক এবং স্থির-স্থিতি ক্ষেত্রেও এটি প্রায়শই মডেল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর উচ্চ-মাত্রিক অ্যানালগগুলি বিশুদ্ধ এবং ফলিত গণিত উভয় ক্ষেত্রেই চর্চিত হয়। একবার বেগ-ক্ষেত্র গণনা করা হলে, গতিশীল সমীকরণ এবং সম্পর্কসূত্র ব্যবহার করে অন্যান্য পরিমাণ পাওয়া যেতে পারে, যেমন চাপ বা তাপমাত্রা। এটি ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে সাধারণত যা দেখা যায় তার থেকে ভিন্ন। সেখানে সমাধানগুলি সাধারণত একটি কণার অবস্থানের ট্র্যাজেক্টোরি বা ধারাবাহিক পথরেখার বিচ্যুতি। কোনো ফ্লুইডের ক্ষেত্রে অবস্থানের বদলে বেগের সমাহার-চিত্র (প্রোফাইল) নিয়ে চর্চা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে দৃশ্যমান করে তোলার প্রয়োজনে বিভিন্ন পথরেখা গণনা করা যেতেই পারে। বিশেষ করে ভেক্টর ক্ষেত্রের স্ট্রিমলাইনগুলিকে যদি প্রবাহ বেগ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে সেই স্ট্রিমলাইনগুলোই হল সেইসব খাত যা বেয়ে ভরহীন কোনো কণা চলতে পারে। এই পথগুলি হল সেইসব ইন্টিগ্রাল কার্ভ, প্রতিটি বিন্দুতে যার ডেরিভেটিভ ভেক্টর ক্ষেত্রের সমান। আর এইগুলিই একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে ভেক্টর ক্ষেত্রের আচরণকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে।
অবস্থানের পরিবর্তে বেগ অধ্যয়ন-করা এই সমীকরণটিকে এখনও সম্পূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সমাধান মেলে – যেমন মসৃণ কুয়েত প্রবাহ (Plane Couette flow) , মসৃণ পোয়াসেউইল প্রবাহ (Plane Poiseuille flow) , পিছল ও পাতলা ফিল্মে মসৃণ পোয়াসেউইল প্রবাহ (Plane Poiseuille flow with slip and thin film flow) , কুয়েত-পোয়াসেউইল যৌথ প্রবাহ (Combined Couette-Poiseuille flow) , হ্যাগান-পোয়াসেউইল প্রবাহ (Hagen-Poiseuille flow) , ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডারের মধ্যে অবিচলিত প্রবাহ (Steady flow between rotating cylinders) । এছাড়াও লুডভিগ প্রান্ড্টালের সীমান্ত স্তরের ধারণা (Concept of Boundary Layers) দিয়েও অনেক জটিল বাস্তব পরিস্থিতিতে N-S সমীকরণের সমাধান পাওয়া যায়। ন্যাভিয়ার-স্টোকস সমীকরণগুলি বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক ঘটনাকে মডেল করার জন্য ভিডিও গেমগুলিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জোস স্ট্যামের ” Real time fluid dynamics for games ” গবেষণাপত্রটি ব্যবহার করে গেম সিস্টেম প্রসেসিং ইউনিট (GPU) প্রযুক্তির বিকাশ আরো অনেক ত্বরান্বিত হয়েছে।
**পরের লেখাটি আগামী বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।