পদার্থবিজ্ঞান ও ‘ননেট’ কবিতা

পদার্থবিজ্ঞান ও ‘ননেট’ কবিতা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৪ এপ্রিল, ২০২৫

জুটি হিসাবে পদার্থবিজ্ঞান আর কবিতা! অদ্ভুত মনে হচ্ছে? কিন্তু এ দুইই তো গঠন আর ছন্দের মধ্য দিয়ে পথ চলে। উভয়ই বিষয়ের জটিল ধারণাগুলিকে সহজ ও সুন্দর রূপে ফুটিয়ে তোলে। এই মহাবিশ্বের কিছু মৌলিক ধারণা বোঝার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি একটি বই বেরিয়েছে, ‘পদার্থবিজ্ঞানের কবিতা’। দেখা যাচ্ছে, কিছু পদার্থবিদ এই সম্পর্কটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। যেমন স্কটিশ পদার্থবিদ ও গণিতবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল যিনি ক্লাসিক্যাল ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন তত্ত্বের নির্মাতা। তিনি তো পরমাণু, তাপগতিবিদ্যা এবং ইম্পস্টার সিন্ড্রোম নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এই সিন্ড্রোমে ভুগলে দক্ষ মানুষও নিজের সা ম র্থ্য সম্বন্ধে অকারণ দ্বিধা ও সংশয়ে ভোগে।
রহস্যে ঢাকা মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটারের গবেষক অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট রেবেকা এলসন মহাকাশ অনুসন্ধান আর মানবীয় দুর্বলতাকে একত্রিত করে কবিতা লিখেছেন। এঁদের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পদার্থবিজ্ঞান শুধু সংখ্যার কারবার নয় , বরং তা নিদর্শন, গতিবিধি আর গভীর অর্থ নিয়ে কাজ করে। বিজ্ঞানের উপর কবিতা লেখা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু কবিতার গঠন এক্ষেত্রে সাহায্যই করে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি যেমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে, কবিতার গঠনগুলিও তো ধারণাগুলোকে আকার দিতে ও লেখাকে নির্দেশিত করতে সাহায্য করে। তা আমাদের ভাবাবে, কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে খোঁজার প্রনোদনা জোগাবে। উভয় ক্ষেত্রেই রূপ জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কবিতার আঙ্গিক একটি বৈজ্ঞানিক ধারণাকে প্রতিফলিত করতে পারে, বর্ণনা করতে পারে। এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ধারণাটির রূপ ও বিষয়বস্তু একসাথে কাজ করে। যেমন, একটি ননেট হল নয়-লাইনের কবিতা, যা একটি নয় মাত্রার পঙক্তি দিয়ে শুরু হয় এবং প্রতি লাইনে এক মাত্রা করে কমতে থাকে, শেষ হয় একটি একমাত্রার শব্দ দিয়ে। এই গঠন একটি স্বাভাবিক হ্রাসের অনুভূতি তৈরি করে, যা ভৌত প্রক্রিয়াগুলিকে, যেমন এনট্রপি বা সমুদ্রের বরফের গলন বুঝতে সাহায্য করতে পারে। সংকুচিত লাইনগুলি তো কেবল একটা গল্পই বলছে না, একটি অনুভূতিকে দৃঢ় করে তুলছে।এন্ট্রপির কথাই ধরা যাক। এনট্রপি হল একটি সিস্টেমের বিশৃঙ্খলা বা এলোমেলো দশার পরিমাপ। উচ্চ এনট্রপিযুক্ত সিস্টেম মানেই বেশি বিশৃঙ্খল। অপরদিকে, নিম্ন এনট্রপি যুক্ত একটি প্রণালী বেশ সংগঠিত। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, একটি বিচ্ছিন্ন সিস্টেমের মোট এনট্রপি কেবল বাড়তেই পারে বা অপরিবর্তিত থাকতে পারে, কখনও কমতে পারে না। বিশৃঙ্খলার এই প্রাকৃতিক অগ্রগতির ব্যাপারটাকে একটি ননেটের মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করা যায়। এক্ষেত্রে কবিতাটি কেবল এনট্রপি ব্যাখ্যা করবে না; এটি একটি অনুভুতির সুযোগ করে দেবে।

চা জুড়িয়ে উষ্ণতা স্রোতের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশে ,
মলিন স্বপ্নের মতো বিচ্ছিন্ন অণুরা সময়ের স্রোতে ভাসে।
তাপের ঢেউ, নীরব সাগরের কাছে মানে হার,
গতিহীন বিলীন মুহূর্তেরা কেবল হিসাব চায়।
গুনগুন সুরে বহতা অ্যাটম,
নিশ্চুপ নিশ্চিত সময়
জুড়োতে থাকে চা
নষ্ট স্বপ্নের
শেষ প্রহর।

শুরুতে একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা বেছে নিতে হবে। সেটি হয়ত বাড়ে, ভেঙে পড়ে, ম্লান হয় বা রূপান্তরিত হয়। যেমন, কৃষ্ণগহ্বরের গ্রাসে আলো কিংবা নিউট্রন তারার শীতল হওয়া। কোয়ান্টাম দশার ঝলকানি। বিষয় নির্বাচনের পর, গঠনের পথনির্দেশ । দীর্ঘতম পঙক্তিটি ধারণাটিকে পরিচিত করিয়ে দেবে, তা থেকে পরে ধারা তৈরী হবে। প্রতিটি পঙক্তি কেবল মাত্রায় নয় বরং তীব্রতায়ও সংকুচিত হওয়া উচিত। ভাষা পরিষ্কার এবং সহজ রাখুন – পদার্থবিদ্যা এবং কবিতা উভয়ই যথার্থতায় বেড়ে উঠবে। কবিতা লেখা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মতো – আপনার প্রথম প্রচেষ্টা সাধারণত চূড়ান্ত সফল না হওয়ারই সম্ভাবনা। যতক্ষণ না গঠন এবং অর্থ একত্রিত হচ্ছে ততক্ষণ সংশোধন চালিয়ে যেতে হবে, সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং পর্যালোচনা চালিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন কবিতার গঠন, পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন দিককে গুরুত্ব দিতে পারে। হয়তো তিন পঙক্তির একটি হাইকু, উনিশ প ঙ ক্তির একটি ভিলানেল, অথবা একটি উনচল্লিশ পঙক্তির জটিল সেস্টিনা? তবে কাঠামোতে আটকে পড়া উচিত নয়। এটিকে ক্ষমতা দান করতে হবে। যেমন কোয়ান্টাম মেকানিকস ক্লাসিক্যাল ফিজিক্সের কাঠামো ভেঙে শতাব্দী পরে আবির্ভূত হয়েছে। মুক্ত ছন্দের কবিতা সবচেয়ে কার্যকর হয় যখন আপনি বুঝতে পারেন, কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের মতো কোনো ভাব বাঁধাধরা সূত্র ভেঙে বেরিয়ে আসছে। একবার কাঠামোবদ্ধ কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে, তখন পূর্বনির্ধারিত কোনও গড়ন ছাড়াই পদার্থবিদ্যা নিয়ে লেখা যায়। ভাষাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে হবে। দেখুন, শব্দগুলি কোথায় নিয়ে যায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 − 6 =