
প্রকৃতির আশ্চর্য খেলায় পপলার গাছ যেন এক নিখুঁত রসায়নবিদ। এরা জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু ডালপালা বা কাঠ নয়, তাদের ভেতরের রসায়নও বদলে ফেলতে পারে। আর এই পরিবর্তন গাছকে টিকে থাকতে সাহায্য করে, তার পাশাপাশি ভবিষ্যতের জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরির নতুন পথও খুলে দেয়।
গাছের কাঠিন্য, শক্তি ও সুরক্ষার মূল উপাদান হলো লিগনিন। এটি একদিকে কোষগুলিকে আঠার মতো জোড়া লাগায়, অন্যদিকে বর্মের মতো বাইরের চাপ, খরা বা রোগ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু একই সঙ্গে লিগনিনই কাঠের ভাঙন বা প্রক্রিয়াজাতকরণকে কঠিন করে তোলে। তাই বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন কীভাবে এর গঠনকে একটু সহজ করা যায়, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ও বায়োপ্লাস্টিক উৎপাদন আরও কার্যকর হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ৪৩০টি পপুলাস ট্রাইকোকার্পার প্রজাতির পপলার গাছ নিয়ে গবেষণা করেন, যা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে দেখা যায়। দেখা যায়, উষ্ণ অঞ্চলের গাছে S/G অনুপাত বেশি, আর ঠান্ডা অঞ্চলে কম। এখানে S/G মানে হলো সিরিঙ্গাইল (S) ও গুয়াইসিল (G) নামের দুটি ভিন্ন লিগনিন উপাদানের অনুপাত। এই ছোট্ট পার্থক্যই কাঠের প্রক্রিয়াজাতকরণকে সহজ বা কঠিন করে তুলতে পারে। বেশি S উপাদান মানেই লিগনিন ভাঙা তুলনামূলক সহজ, যা জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনে খরচ ও দূষণ দুটোই কমায়।
গবেষণায় আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য সামনে এসেছে – পপলার গাছে ল্যাকেস নামের এক উৎসেচক লিগনিনের অনুপাত নিয়ন্ত্রণ করে। জিনগত স্তরে এই এনজাইমের সামান্য পরিবর্তনও গাছের কাঠের গুণমান বদলে দেয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পরিবর্তন সাধারণত যেখানে-সেখানে নয়, বরং ভিন্ন স্থানে ঘটে। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে যে গাছের ভেতরে লিগনিন গঠনের নিয়ন্ত্রণ অনেক জটিল।
গবেষকরা আরও একটি বিরল আবিষ্কার করেছেন : পপলার কাঠে C-লিগনিন এর উপস্থিতি। এতদিন ধরে এটি কেবল ভ্যানিলা বা ক্যাকটাসের মতো কিছু বীজে পাওয়া যেত। এই ধরনের লিগনিনকে ভাঙা অনেক সহজ, তাই বায়োপ্লাস্টিক ও পরিবেশবান্ধব রাসায়নিক উৎপাদনে এটি একদম উপযুক্ত কাঁচামাল। যদিও মাত্র অল্প পরিমাণে পাওয়া গেছে, তবু বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, সঠিক জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এটি বাড়ানো সম্ভব।
সব মিলিয়ে গবেষণার বার্তা স্পষ্ট – গাছের জিন ও পরিবেশ মিলে লিগনিনকে গড়ে তোলে। জলবায়ু যত উষ্ণ, S/G অনুপাত তত বাড়ে। প্রোটিনের ভিন্নতা এবং বিরল লিগনিনের উপস্থিতি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। বিজ্ঞানীরা এখন এমন গাছ তৈরি করার স্বপ্ন দেখছেন, যাদের কাঠ সহজে ভেঙে জ্বালানি ও প্লাস্টিকে রূপান্তর করা যাবে।
এর ফলে আমাদের খনিজ তেল ভিত্তিক নির্ভরতা কমবে এবং আমরা বনভূমি থেকেই জ্বালানি ও উপকরণ পাব। প্রকৃতি যেমন গাছকে রক্ষা করতে লিগনিন ব্যবহার করে, মানুষও সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সবুজ জ্বালানি ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।
সূত্র: Factors underlying a latitudinal gradient in the S/G lignin monomer ratio in natural poplar variants by Weiwei Zhu, et.al ; Proceedings of the National Academy of Science ; (২০.8.2025).