
উপকুলের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে বলে এক ধরনের সীলমাছকে বলা হয় বন্দরের সীলমাছ’ (হারবার সীল)। উপরে সূর্যের আলো থাকলেও, সমুদ্রের নীচের জল ঘোলাটে, সেখানে ঘন অন্ধকার। সেখানে ‘ কোনো প্রযুক্তি ছাড়াইএরা কীভাবে পথ খুঁজে পায়? । উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ওদের চোখ আর স্মৃতিতে। বন্দরের সীলমাছ (ফোকা ভাইটুলিনা) তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তিকে একটি জীবন্ত রেডারের মতো ব্যবহার করে। চক্ষু ঘটিত আলোকপ্রবাহ হলো একটা বিন্যাস। প্রাণীরা যখন কোনো বস্তুর পাশ দিয়ে যায় তখন তাদের অক্ষিপটের উপর এই বিন্যাস ফুটে ওঠে। গবেষকরা এই ব্যাপারটাই পরীক্ষা করতে চাইলেন, তিনটি বন্দর সীলকে খেলিয়ে। এ জন্য তিনটি বিশেষ দৃশ্য সিমুলেট করা হল। দেখা গেল, এরা আশেপাশের দৃশ্য নির্ভর সংকেত ধরতে পারদর্শী। এমনকি জলের নীচে, যেখানে প্রায় আলো নেই বললেই চলে, সেখানেও তারা নানা দৃশ্যনির্ভর সংকেত ব্যবহার করে আশপাশের গঠন চিহ্নিত করে, যথা পাথর, শৈবাল, কিংবা অন্য কোনো ডুবন্ত কাঠামো। গবেষকরা সীলদের একটি বিশেষ জলাধারে নিয়ে এসে পরিবেশ বদলে বদলে দেখেন, সীলেরা চোখ দিয়েই সব পর্যবেক্ষণ করছে। তারা দৃশ্য সংকেত মনে রেখে পরে আবার সেই জায়গা চিনে ফেলে অনায়াসে। এ যেন দেখা নয় মস্তিষ্কে মানচিত্র আঁকা ! ঠিক যেমন আমরা রাস্তাঘাট, ল্যাম্পপোস্ট, দোকান দেখে পথ চিনে রাখি। সীলেরা মনে রাখে জলের নীচে পাথরের গঠন, আলো-ছায়ার খেলা, এবং জলের অভিমুখ ।এদের মস্তিষ্কে গড়ে ওঠে একধরনের বোধবুদ্ধির মানচিত্র’ যা দৃশ্য স্মৃতির ভিত্তিতে তৈরি। এই মানচিত্র ব্যবহার করেই তারা পরবর্তী সময়ে পুনরায় সেই পরিবেশে ফিরে গিয়ে ঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে। এ যেন জলজগতের অদৃশ্য গুগল ম্যাপ, যা চোখ আর মস্তিষ্ক মিলিয়েই তৈরি করেছে প্রকৃতি। সমুদ্রের নিচে বেঁচে থাকার লড়াইটা সহজ নয়। সেখানে শিকারি যেমন থাকে তেমনই খাদ্যের ভাঁড়ার সীমিত। তার উপর অন্ধকার পরিবেশ।এই পরিস্থিতিতে বন্দরের সীল তাদের দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তির মিশ্রণে নিজেদের যাপনকে রক্ষা করে যাচ্ছে। শুধু পথ খোঁজা নয়, সীলেরা এই দৃশ্য নির্ভর সূত্র ব্যবহার করে শিকারকে অনুসরণ করে, সঙ্গীদের খুঁজে বের করে, এমনকি বিপদ থেকে বাঁচে। এদের এই জৈব প্রযুক্তি থেকে মানুষও অনেক কিছু শিখতে পারে। বিজ্ঞানীরা ভাবছেন, কীভাবে এই দৃষ্টিশক্তি ও বোধবুদ্ধি ভিত্তিক মানচিত্র রচনার ধারণাটিকে ব্যবহার করে জলের নীচে চলাচলকারী রোবট বানানো যায়। যদি কোনও সাবমেরিন বা ড্রোন সীলের মতো অন্ধকার জলে দৃশ্য সূত্র দেখে পথ খুঁজে নিতে পারে, তাহলে তো কথাই নেই। এরা শুধু সাঁতারু নয়, পরিবেশ-সংবেদি অনুসন্ধানকারী। সুতরাং এরা নির্বোধ তো নয়ই, বরং প্রাকৃতিকভাবে প্রযুক্তির চেয়েও বেশি সূক্ষ্ম, বেশি অভিজ্ঞ।