পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও মানবকৃষ্টি

পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও মানবকৃষ্টি

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

প্রায় ৪১ হাজার বছর আগে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ভেঙে পড়েছিল। তার শক্তি বর্তমানের চেয়ে ১০ শতাংশ কমে গিয়েছিল । সেই সময় পৃথিবীর প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ ম্যাগনেটোস্ফিয়ার আর সেভাবে সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ ঠেকাতে পারেনি। ফলে অতিবেগুনি রশ্মি ও সৌরঝড়ের তীব্র প্রভাবে মানবজীবন ও পরিবেশে নেমে এসেছিল নাটকীয় পরিবর্তন। এই বিরল ঘটনা ইতিহাসে পরিচিত “লাশঁ এক্সকার্শন” (Laschamps Excursion) নামে। এটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ফ্রান্সের আগ্নেয়গিরির ভস্মস্তরে। এ কোনো পূর্ণাঙ্গ চৌম্বক মেরু-বদল ছিল না, বরং ছিল এক বিশৃঙ্খল সময়কাল। তখন চৌম্বক মেরুগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার সরে গিয়ে দুর্বল ক্ষুদ্র মেরুরূপে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। লাশঁ এক্সকার্শনের সময় মেরুজ্যোতি বা অরোরা সরে এসেছিল বিষুবরেখার কাছাকাছি। আকাশ হয়তো ছিল মনোমুগ্ধকর, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল মারাত্মক বিকিরণ-ঝুঁকি। ত্বক পোড়া, চোখের ক্ষতি, জন্মগত ত্রুটি- এসমস্ত বিপদ বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। মানুষ এই অদৃশ্য বিপদের মোকাবিলায় অবলম্বন করেছিল নানা উপায়। গুহায় বসবাস ছিল সেই বিকিরণ থেকে সুরক্ষা লাভের প্রাকৃতিক আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে সে ত্বক ঢাকা দেওয়ার জন্য তৈরি করেছিল বিশেষ আবরণ। এমনকি লাল গেরুয়া মাটি দিয়ে শরীর আচ্ছাদিত রাখত, যা বিকিরণ রোধে ছিল কার্যকর। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ হয়, ইউরোপে বসবাসকারী নিয়ান্ডারথাল ও হোমো স্যাপিয়েন্স উভয়েই এই সময়ে ওই ধরণের সুরক্ষামূলক আচরণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে তাদের প্রতিক্রিয়ার ধরন ছিল ভিন্ন। কেউ বেশি নির্ভর করত প্রাকৃতিক আশ্রয়ের উপর, কেউ বা বস্ত্র ও খনিজ ব্যবহারেরউপর। এই গবেষণা চলেছে এক অভিনব সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও দুইজন ভূ-ভৌত বিজ্ঞানী মিলে চেষ্টা করেন মহাকাশ আবহাওয়া ও মানব আচরণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার। তাদের মতে, মহাকাশের আবহাওয়া কিংবা চৌম্বকক্ষেত্রের অদৃশ্য পরিবর্তন শুধু তখনকার মানুষের জীবনযাত্রাকেই প্রভাবিত করেনি। বরং এটি মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও অভিযোজন কৌশলেরও এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছিল। তারা জানান, এই ঘটনা নিয়ান্ডারথালদের বিলুপ্তির সরাসরি কারণ ছিল না, বরং এটি ছিল বহু পরিবেশগত চাপের সঙ্গে যুক্ত এক অদৃশ্য উপাদান। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র এর আগেও বহুবার দুর্বল হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ কীভাবে সেই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়েছিল, তা জানা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রস্তুতিতে সহায়ক হতে পারে। প্রত্নতত্ত্ব ও ভূ-ভৌত বিজ্ঞানের এই আন্তঃবিষয়ক গবেষণা প্রমাণ করে যে, মহাকাশ কেবল এক দূরবর্তী স্থান নয়, এর প্রভাব ছড়িয়ে আছে আমাদের নিত্য জীবনে। কখনও সেটা স্পষ্ট হয় আকাশের রঙিন মেরুপ্রভায়। কখনও লুকিয়ে থাকে গেরুয়া রঙ লেপা শরীরে কিংবা এক টুকরো পশমের আচ্ছাদনে।

 

সূ ত্র: Reference: “Wandering of the auroral oval 41,000 years ago”16 April 2025, Science Advances.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 + 2 =