পৃথিবীর চৌম্বক ঢাল

পৃথিবীর চৌম্বক ঢাল

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৬ আগষ্ট, ২০২৫

পৃথিবী সৌভাগ্যবতী। সূর্য ও মহাকাশ থেকে আসা প্রাণঘাতী বিকিরণকে ঠেকিয়ে রেখেছে এর চৌম্বক ক্ষেত্র। এ এক অদৃশ্য ঢাল, যা জীবজগৎ ও বায়ুমণ্ডলকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। মঙ্গল গ্রহ প্রভৃতি বাকি গ্রহগুলিতে এরকম ঢাল না থাকায় সেগুলি অনবরত মহাজাগতিক বিকিরণের আঘাতে জর্জরিত। পৃথিবীর এই চৌম্বক ঢালের উৎস কী? দশকের পর দশক ধরে ভূ-পদার্থবিদরা ‘ভূ -ডাইনামো থিওরি’ দিয়ে পৃথিবীর চৌম্বকত্ব ব্যাখ্যা করে আসছেন। পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা গলিত লোহা-নিকেল ক্রমাগত ঘূর্ণায়মান এবং উত্তপ্ত হয়ে পরিচলন স্রোত সৃষ্টি করে। পৃথিবীর ভেতরের গলিত ধাতু গরম হয়ে উপরের দিকে উঠে আসে। ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার নীচে নামে। এইভাবে কেন্দ্রে এক অবিরাম প্রবাহ তৈরি হয়। আর এই প্রবাহই চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরিতে সাহায্য করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন সেই স্রোতকে পাক খাওয়া স্ক্রু-আকৃতির গতিতে পরিণত করে। এই চলমান ধাতুগুলিই উৎপন্ন করে বৈদ্যুতিক স্রোত আর তা থেকেই জন্ম নেয় চৌম্বক ক্ষেত্র। কিন্তু একটি প্রশ্ন : যখন পৃথিবীর অভ্যন্তরে কঠিন কোনো স্তর ছিল না, শুধুই তরল স্তর ছিল, তখনও কি এই ভূ -ডাইনামো কাজ করত? সেই সময়ে কি পৃথিবী নিজের চারপাশে এই চৌম্বক ঢাল তৈরি করতে পেরেছিল? সুইজারল্যান্ডের ETH Zurich ও চীনের SUSTech-এর তিনজন ভূ-পদার্থবিদ একে ঘিরেই তৈরি করেছেন এক নতুন কম্পিউটার মডেল। তারা প্রমাণ করেছেন, পুরোপুরি তরল অভ্যন্তরীণ স্তর দিয়েও সেই সময় পৃথিবী একটি স্থিতিশীল চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিল। তাদের গবেষণার বড় সমস্যা ছিল সান্দ্রতা অর্থাৎ তরল প্রবাহের বাধা। এ এমন এক ভৌত বৈশিষ্ট্য, যা কোন তরল বা গ্যাস প্রবাহে কতটা বাধা পায়, তা জানিয়ে দেয়। বাস্তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ স্তরে এই সান্দ্রতা অত্যন্ত কম। কিন্তু গণনার সুবিধার্থে, অধিকাংশ কম্পিউটার মডেলে এই মান কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয় । ফলে প্রকৃত চিত্রটি বিকৃত হয়। এই গবেষক দলের মডেল এই সমস্যা দূর করেছে। সুইস সুপারকম্পিউটার Piz Daint-এর মাধ্যমে তারা এমন এক গণনা সম্পন্ন করেছেন যেখানে সান্দ্রতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। ফলাফল? ডাকগা গেছে সম্পূর্ণ গলিত অভ্যন্তরীণ স্তরেও একটি নিজগুণে -টেকসই চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এই মডেলে দেখা গেছে, প্লবতা তাড়িত পরিচলন আর ঘূর্ণনের পাক খাওয়া প্রভাব একসাথে যথেষ্ট সক্রিয়। কোনো প্রবাহ বা চলন যখন পাক খেতে খেতে ঘূর্ণায়মান আকার নেয়, পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে তখন সেই প্রবাহে একটি মোচড় বা পেঁচানো গতি যোগ হয়- পুরনো কোনো স্তর ছাড়াই। এ এক চমকপ্রদ আবিষ্কার । এর মানে, পৃথিবীর চৌম্বক ঢাল সেই সময় থেকেই সক্রিয় ছিল। যেটা আগে ভাবা হত অসম্ভব। কাজেই বায়ুমণ্ডল ও জীবনের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ষা-বর্ম হয়তো আরও প্রাচীন, আরও দীর্ঘস্থায়ী। ETH-র অধ্যাপক অ্যান্ডি জ্যাকসন বলেছেন, “এই গবেষণা পৃথিবীর প্রাচীন চৌম্বক ইতিহাস বুঝতে সাহায্য করে এবং ভূতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।” কেবল পৃথিবী নয়, সূর্য, বৃহস্পতি বা শনি গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র বিশ্লেষণেও এই মডেল কার্যকর হতে পারে। আমাদের আধুনিক সভ্যতাও তো এই চৌম্বক ঢালের উপর নির্ভরশীল। নৌচালন, উপগ্রহ, ইলেকট্রিক গ্রিড সবকিছুই এই ঢালের সুরক্ষায় চলে। তাই, কিভাবে এই ক্ষেত্র তৈরি হয়, পরিবর্তিত হয় এবং কতটা স্থায়ী তা বোঝা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নতুন মডেল ভবিষ্যতের চৌম্বক বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণীতেও সাহায্য করতে পারে। যেমন মেরু পাল্টানো বা উত্তর চৌম্বক মেরুর দ্রুত সরে যাওয়া ইত্যাদি।

সূত্র : Invariance of dynamo action in an early-Earth model by
Yufeng Lin, et.al ; Nature(30 July, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

18 − 6 =