পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ চাঁদের মাটিতে

পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ চাঁদের মাটিতে

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ৩ আগষ্ট, ২০২৪
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ চাঁদের মাটিতে

চারদিকে সাদা বরফের মধ্যে প্রকাণ্ড সিড ভল্টে দশ লাখেরও বেশি জাতের হিমায়িত বীজ রাখা। নরওয়ের স্বালবার্ডের এই গ্লোবাল সিড ভল্ট বৈশ্বিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বের খাদ্য সংকট রুখতে শস্যবৈচিত্র্যের ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে। আর্কটিকের প্রায় ৪০০ ফুট গভীরে অবস্থিত এই ভল্টটা বিদ্যুৎ ছাড়াই বীজ সংগ্রহকে হিমায়িত রাখতে সক্ষম। কিন্তু ২০১৭ সালে, গলিত পারমাফ্রস্টের জলের বন্যা এই বীজ সংগ্রহকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। এই বীজ ভল্ট তখন থেকে জলরোধী করা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা দেখিয়েছে আর্কটিক, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
এই সিড ভল্টের ঘটনা থেকে স্মিথসোনিয়ান’স বিজ্ঞানীরা চাঁদে জৈবিক উপাদান ক্রায়োজেনিকভাবে সংরক্ষণ করে পৃথিবীর ক্ষতিগ্রস্থ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার পরিকল্পনা করেছেন। গবেষকদের মতে, চাঁদের যে গর্তগুলোতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনা, তা যথেষ্ট ঠান্ডা। বিদ্যুৎ বা তরল নাইট্রোজেন ছাড়াই এখানে ক্রায়োজেনিক সংরক্ষণ করা সম্ভব। বায়োসায়েন্সে প্রকাশিত স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল জু অ্যান্ড কনজারভেশন বায়োলজি ইনস্টিটিউট (এনজেডসিবিআই), স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম এবং অন্যান্যদের গবেষকদের সহযোগিতায় গবেষণাপত্রে চাঁদে বায়োরিপোজিটরি তৈরির জন্য একটা রোডম্যাপের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকার জৈবিক উপাদান সংরক্ষণ করা হবে, বিকিরণ, মাইক্রোগ্র্যাভিটির মতো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা ও সংরক্ষণ বিষয়ে কী ধরনের পরিচালন ব্যবস্থা লাগবে তাও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, চাঁদের বায়োরিপোজিটরিতে বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতিগুলো রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রজাতিকে ক্রায়োপ্রিজারভ করা।
প্রাণী কোশ খুব কম স্টোরেজ তাপমাত্রায়(-৩২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সংরক্ষণ করতে হয়। গাছের জন্য যেমন বীজ তেমন প্রাণীর সংরক্ষণের জন্য চামড়ায় অবস্থিত ফাইব্রোব্লাস্ট কোশ সংরক্ষণ করার কথা ভাবা হচ্ছে। পৃথিবীতে, প্রাণী কোশ ক্রায়োপ্রিজারভ করার জন্য তরল নাইট্রোজেন, বিদ্যুৎ এবং প্রচুর কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু এই তিনটেই সম্ভাব্য বিঘ্ন হলে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে একটা সম্পূর্ণ সংগ্রহ ধ্বংস হতে পারে, যেভাবে নরওয়ের সিড ভল্ট ঝুঁকির মুখে পড়েছিল। এই ঝুঁকির হাত থেকে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য গবেষকরা চাঁদের গর্তের কথা ভেবেছেন। চাঁদের মেরুর দিকে অনেক গর্ত অবস্থান আর গভীরতার জন্য কোনোদিন সূর্যের আলোর মুখ দেখেনা। এসব জায়গার তাপমাত্রা -৪১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের জন্য আদর্শ। আর মহাকাশের বিকিরণে ডিএনএ-র ক্ষতি আটকাতে চাঁদের শিলা দিয়ে তৈরি কাঠামোয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
গবেষকরা পৃথিবীতে এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পরীক্ষা চালানোর জন্য অংশীদার খুঁজছেন। পরীক্ষায় চাঁদে বিকিরণ এবং মাইক্রোগ্রাভিটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রোটোটাইপ প্যাকেজিংয়ের ক্ষমতা দেখা হবে। এছাড়া দেশ বিদেশের সরকারি, বেসরকারি অনুদান, বিজ্ঞানীদের সাহায্যের কথা তারা ভেবেছেন। গবেষকদের মতে এই বায়োরিপোজিটরি পৃথিবীর মূল্যবান জীবন যা মহাবিশ্বে বিরল তার বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আরেকটা সমান্তরাল পদ্ধতি। আমাদের পৃথিবীতে জীবন কখনও ধ্বংস হয়ে গেলেও চাঁদে জীবন নতুন পৃথিবীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে।