প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য গবেষণা

প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য গবেষণা

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৪ মে, ২০২৫

ক্যাটারিনা ভিলা-পুকা এবং আলেকজান্ডার কোটরশাল মাছকে ধরে ল্যাবে আনার পরিবর্তে, ল্যাবটিকেই মাছেদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে নিয়ে আসেন। তাঁদের উদ্ভাবিত ফিডিং বোর্ড নামক যন্ত্রটি একটি ৩০×৩০ সেমি পিভিসি বোর্ড, যাতে ২৪টি ছোট ছিদ্র রয়েছে, প্রতিটি ছিদ্র একটি শলাকার ওপর বসানো চাকতি দ্বারা আবৃত। প্রতিটি চাকতির নীচে পুরস্কার হিসেবে থাকে একটি খাদ্য। যন্ত্রটি হালকা, বহনযোগ্য। প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য, গবেষকরা ত্রিনিদাদের আরিপো নদীতে প্রাণবন্ত সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার জন্য পরিচিত প্রাকৃতিক গাপ্পি মাছকে বেছে নেন। এই মাছ কীভাবে দলগত পরিবেশে নানান অভিযোজন প্রক্রিয়া শেখে তার মূল্যায়ন করাই ছিল উদ্দেশ্য। গবেষকরা আহার বোর্ডটি স্থাপন করে গাপ্পিগুলি কীভাবে এগিয়ে আসছে তা পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথমে মাছগুলি স্তম্ভিত হয়ে যায়। চাকতিগুলিকে ধাক্কা দিয়ে, দূরে সাঁতরে সরে গিয়ে তারপর ফিরে আসতে থাকে। কিছু কিছু মাছ তখনই আবিষ্কার করে ফেলে, সঠিক চাকতিগুলিকে ঠেলে দিলেই খাবার পাওয়া যাবে। প্রাথমিক পরীক্ষার শেষে, নয়টি গাপ্পি অসাধারণ ধাঁধা সমাধানকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। এরা সফলভাবে ২০% এরও বেশি সঠিক চাকতি সরিয়ে ফেলতে পারে। তারা কেবল অধ্যবসায়ীই নয়, শেখেও তাড়াতাড়ি। ইতিমধ্যে, অন্যান্য গাপ্পিরা তাদের পরিশ্রমী সহকর্মীদের প্রচেষ্টা থেকে উপকৃত হয় এবং তারা অপেক্ষা করতে থাকে। ফলে, একটি আকর্ষণীয় ধরণ তৈরি হয়। কিছু গাপ্পি “প্রযোজক” হয়ে ওঠে- তারা সক্রিয়ভাবে কাজটি সমাধা করে এবং পুরস্কার পায়। অন্যরা “লোভী” চরিত্রের, কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায় এবং একজন প্রযোজকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল খাদ্য পুরস্কারটিকে ছিনিয়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আগাগোড়া এই কৌশল অব্যাহত থাকে। একেকটি মাছ উৎপাদক হিসাবে নিজের আধিপত্য বজায় রাখে এবং অন্যরা কেবল নিজেদের স্বার্থসন্তুষ্টিতেই তুষ্ট থাকে। এটি বিস্তৃত সামাজিক খাদ্য সংগ্রহের গতিশীলতার প্রতিফলন।

ত্রিনিদাদের পরীক্ষার পর গবেষকরা নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিষ্টি জলের পুকুরে যান। এবার গবেষণার পাত্র ছিল পর্যবেক্ষণ দক্ষতার জন্য বিখ্যাত নাইনস্পাইন স্টিকলব্যাক মাছ। স্টিকলব্যাকদের আচরণ কিন্তু গাপ্পিদের তুলনায় কম পরিবর্তনশীল। তারা প্রায় সকলেই আহার বোর্ডের সাথে যুক্ত হতে থাকে। বেশিরভাগ মাছ সক্রিয়ভাবে চাকতিগুলি সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ফলে সমতাবাদী কর্ম-বন্টন তৈরি হয়। তবে তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত পার্থক্যও ছিল। কিছু স্টিকলব্যাক কাজটি দ্রুত শিখে নেয়, অনেকের আবার দেরি হয়।

প্রতিটি আন্তঃক্রিয়া নথিভুক্ত করার ফলে গবেষকরা নির্দিষ্ট করতে পেরেছিলেন যে কোন মাছ সময়ের সাথে সাথে উন্নত হয়েছে এবং কোনটি সমস্যায় পড়েছে। ত্রিনিদাদের পরীক্ষায়, নয়টি গাপ্পি ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতিকে পরিমার্জন করেছিল। এই মাছগুলি আরও ঘন ঘন কাজটি সমাধান করেছিল, উপরন্তু পূর্ববর্তী সাফল্যের উপর ভিত্তি করে কৌশলগুলিকেও অভিযোজিত করেছিল। অন্য মাছরা খুব কমই স্বাধীনভাবে কাজটি সমাধান করার চেষ্টা করেছে। তারা কাছাকাছি ঝুলে থাকত, প্রযোজকদের পুরষ্কার আবিষ্কারের অপেক্ষায়। সামাজিক শিক্ষা কীভাবে জ্ঞানীয় কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করে তা তুলে ধরে এই আচরণ। কিছু মাছ সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে স্পষ্টতই উৎকৃষ্ট ছিল, কিছু আবার সুযোগসন্ধানী হিসেবে সাফল্য লাভ করেছিল।
ফিডিং বোর্ড বা আহার চাকতিটিকে সত্যিকার অর্থে যুগান্তকারী করে তোলে এর বহুমুখী ব্যবহার। নেদারল্যান্ডসের গবেষণায়, গবেষক দলটি মাছকে বিরক্ত না করে প্রতিটি পারস্পরিক সহযোগিতা নথিভুক্ত করার জন্য একটি ভিডিও ক্যামেরা যুক্ত করেন। এই পদ্ধতিটি গোষ্ঠীগত এবং ব্যক্তিগত শেখার গতিপথ সম্পর্কে আরও গভীর ধারণা প্রদান করেছে। গাপ্পিদের তুলনায় স্টিকলব্যাকদের মধ্যে আরও অভিন্ন শেখার ধরণ দেখা যায়, কম প্রভাবশালী মাছেরাও একই কাজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
এইভাবে প্রাকৃতিক আবাসস্থলের মধ্যে প্রাণীদের পরীক্ষা করে, তাদের খাঁটি আচরণ আরও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

10 + four =