
সম্প্রতি মানবজাতির প্রাচীন পূর্বপুরুষদের নতুনভাবে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের নারী ও পুরুষের দেহের আকারে ছিল বিশাল ফারাক। পুরুষরা ছিল অনেক বড় আকারের। আর এই পার্থক্য তাদের দৈনন্দিন জীবন, প্রতিযোগিতা ও সামাজিক সম্পর্কেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
গবেষণাটি চালিত হয় মূলত দুই প্রাচীন মানব প্রজাতিকে কেন্দ্র করে। এক, প্রায় ৩.৮৫–২.৯৫ মিলিয়ন বছর আগের পূর্ব আফ্রিকার অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস। দুই, প্রায় ৩.৩–২.১ মিলিয়ন বছর আগের দক্ষিণ আফ্রিকার অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানুস। দীর্ঘদিন ধরে “লুসি” নামের ক্ষুদ্র আকারের একটি আফারেনসিস কঙ্কাল আমাদের ধারণা গড়ে তুলেছিল। কিন্তু নতুন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লুসি পুরো প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে না। এদের মধ্যে অনেক বড় দেহের নমুনাও ছিল, আর সেই পার্থক্য লিঙ্গভিত্তিক।
বিজ্ঞানীরা এটিকে বলেন ডাইমরফিজম/ দ্বিরূপতা, অর্থাৎ একই প্রজাতির নারী ও পুরুষের মধ্যে স্থায়ী শারীরিক পার্থক্য। আধুনিক মানুষকে একটি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হলে দেখা যায়—আজকের পুরুষ নারীর তুলনায় গড়ে ১২–২৫% ভারী, কিন্তু গরিলার ক্ষেত্রে এ পার্থক্য ৬৬–১৪৬% পর্যন্ত। নতুন জীবাশ্ম গবেষণায় দেখা গেছে, আফারেনসিস ও আফ্রিকানুস মানুষের চেয়ে অনেক বেশি গরিলার মতো দ্বিরূপতা দেখিয়েছে। প্রাইমেটদের মধ্যে পুরুষদের আকার বড় হলে সাধারণত এর সঙ্গে যুক্ত থাকে তীব্র পুরুষ-পুরুষ প্রতিযোগিতা এবং বহুগামিতা (যে প্রজনন ব্যবস্থায় এক পুরুষ একাধিক নারীর সঙ্গে মিলিত হয়)। এর মানে হতে পারে, সেই সময়ে বড় পুরুষরা প্রতিযোগিতা, এলাকা দখল এবং সঙ্গী পাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেত।
এই গবেষণাটির পদ্ধতিগত নতুনত্ব ছিল। বিজ্ঞানীরা ভাঙা বা অসম্পূর্ণ হাড়কে সরাসরি পুরুষ বা নারী হিসেবে চিহ্নিত না করে, গাণিতিক কাঠামো ব্যবহার করে সামগ্রিক আকারের বিস্তার তুলনা করেছেন। এতে ৮টি হাত-পায়ের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে আধুনিক মানুষ, শিম্পাঞ্জি ও গরিলার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। ফলাফল থেকে স্পষ্ট দেখা গেছে আফারেনসিসে দ্বিরূপতা সবচেয়ে প্রকট, আফ্রিকানুসেও তা প্রবল, তবে কিছুটা কম।
এই ফলাফল পুরনো ব্যাখ্যা বদলে দিয়েছে। ২০০৩ সালের একটি গবেষণা দাবি করেছিল আফারেনসিসে মানবসদৃশ সমতা ছিল। কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, আসলে তারা ছিল বৃহদাকার পুরুষ ও ছোট আকারের নারীর সমন্বিত এক প্রজাতি। লুসি ছিল ছোট, কিন্তু তার সমসাময়িকরা ছিল অনেক বড়। আর পার্থক্যটি ছিল লিঙ্গভিত্তিক, কেবল ভৌগোলিক কারণে বা আকস্মিকতার কারণে নয়।
এই আবিষ্কার থেকে দেখা যায়, প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর সামাজিক জীবন ছিল অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে শক্তি ও আকার পুরুষদের আধিপত্য নিশ্চিত করত। গবেষক অ্যাডাম ডি. জর্ডন লিখেছেন, এই ফলাফল থেকে প্রবল যৌন নির্বাচনের ইঙ্গিত মেলে, যেখানে বড় আকারের পুরুষেরা বিবর্তনে এগিয়ে থাকত।
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা অনেক সময় ব্যর্থ হয় একই কারণে – ছোট নমুনা। নতুন গবেষণায় এ কথা খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে।
পরিসংখ্যানের সরল নিয়ম হলো, বড় প্রভাবকে ছোট নমুনা দিয়ে ধরা যায়। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে: দুই প্রজাতিতেই প্রভাব এতটাই বড় ছিল যে ছোট নমুনায়ও ফলাফল স্পষ্ট দেখা গেছে। এখন পরবর্তী ধাপ হলো একই বিশ্লেষণকে অন্য প্রাচীন হোমিনিন প্রজাতির ওপর প্রয়োগ করে দেখা যে, একই ধারা বারবার দেখা যায়, নাকি নতুনভাবে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল আসে।
তথ্যসূত্র : Sexual Size Dimorphism in Australopithecus: Postcranial Dimorphism Differs Significantly Among Australopithecus afarensis, A. africanus, and Modern Humans Despite Low-Power Resampling Analyses by Adam D. Gordon ,et.al ; American Journal of Biological Paleoanthropology (Volume 187,Issue 8) (First published: 11th July, 2025)