বারে বারে কেন মহামারি আকারে ফিরে এসেছে প্লেগ?

বারে বারে কেন মহামারি আকারে ফিরে এসেছে প্লেগ?

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ২৪ জুলাই, ২০২৪
জীবাণু-প্লেগ

জীবাণুর সঙ্গে মানুষের লড়াই দীর্ঘ। মানব ইতিহাস জুড়ে, বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। এই কয়েক বছর আগে করোনা-আতঙ্কে কাঁপছিল গোটা দুনিয়া। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এটাই প্রথম অতিমারি নয়। এর আগেও বহু বার ব্যাপক আকারে হানা দিয়েছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো আণুবীক্ষণিক শত্রু। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে সেই সব রোগ। কিছু দিনের জন্য হারিয়ে গিয়ে ফের তারা ফিরে এসেছে ভয়াল চেহারায়। কিছু কিছু রোগ আজও টিকে আছে, যেমন যক্ষ্মা।
বিংশ শতাব্দীর আগে বিউবোনিক প্লেগ ইউরোপ এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে প্রাণঘাতী রূপে দেখা দেয়। বিগত ১৫০০ বছরে এই রোগ তিনবার মহামারি আকেরে দেখা দেয়। প্রথমটি ঘটেছিল পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে, ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায়। প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ এই রোগের কারণে মারা যায়। বাইজেন্টাইন, সাসানিয়ান এবং রোমান সাম্রাজ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল এই রোগ। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে হানা দিয়েছিল প্লেগ। সেই মহামারি ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামেই কুখ্যাত। প্রায় ৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং সমগ্র ইউরোপ জুড়ে প্রায় ৫০% মানুষ এই রোগে মারা গিয়েছিল। এই মহামারির তৃতীয় তরঙ্গ উনিশ এবং বিশ শতকে বিশ্বব্যাপী ছড়ায় এবং আরও ৩০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে, বিশেষ করে চিন এবং ভারতে। তবে ১৯৬০-এর দশক থেকে, রোগের তীব্রতা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। কিন্তু, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নতুন কেস দেখা দিয়েছে যার ফলে এই রোগের প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে । যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিশ্বের কিছু ভৌগলিক অঞ্চলে ছোটো ছোটো পকেটে রোগটির অস্তিত্ব রয়েছে এবং পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে সেই সম্প্রদায়গুলোতে রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিউবোনিক প্লেগ, বা সংক্ষেপে প্লেগ, ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস নামের ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট। মাছি থেকে ইঁদুরে ছড়ায় সেই রোগ, ইঁদুর থেকে মানুষে। এই জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট প্লেগ তিন ধরণের। প্রতিটির ক্ষেত্রে সংক্রমণ শরীরের আলাদা অংশে ঘটে। নিউমোনিক প্রধানত ফুসফুসে, সেপ্টিসেমিক প্রধানত রক্তে, এবং বিউবোনিক লিম্ফ নোডগুলোতে। যদিও সংক্রমণের সময় একটি থেকে অন্যটিতে সংক্রমণ ঘটতে পারে। বিউবোনিক প্লেগে আক্রান্ত ব্যক্তির কবজি বা বগলে টিউমারের মতো বেশ বড়ো ফোঁড়া হত। তার পরে সারা শরীরে ছেয়ে যেত ফোঁড়া। এক সময়ে সেগুলো পচে গিয়ে পুঁজ বেরোত এবং সাত দিনের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হত।
বিশ্ব জুড়ে স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, ইঁদুরের সংস্পর্শে আসাকে মানুষ রোধ করেছে। প্লেগ সংক্রমণের চক্রকে ভেঙে দিয়েছে। ১৯৬০ এর দশক থেকে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার, বিশেষ করে ফ্লুরোকুইনোলোন, প্লেগের সংক্রমণ হ্রাস করেছে। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়েছে। তবে আজও আমরা কিছু কিছু হটস্পটে, প্রধানত এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় প্লেগের সংক্রমণ দেখতে পাই। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, পেরু এবং মাদাগাস্কার সবচেয়ে বেশি কেস দেখা গেছে। তবে গবেষকদের মতে প্লেগ সম্ভবত কখনই নির্মূল হবে না। মাছি, ইঁদুর এবং মানুষের এই জটিল সংক্রমণ চক্রের কারণে, এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা এবং চিকিত্সা করা প্রায় অসম্ভব। তবে, সঠিক ব্যবস্থা, দ্রুত এবং কার্যকর চিকিত্সার মাধ্যমে প্রতি বছর প্লেগের সংখ্যা কমছে। এটিই একমাত্র আশার আলো।