বিজ্ঞানভাষ দৈনিক হিসেবে আসছে। মাধ্যম আন্তর্জালিক। মূল লক্ষ্য, বিজ্ঞানের খবর সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিজ্ঞান-বিষয়ক খবর বাঙালি পাঠকের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। বিজ্ঞান দৈনিক, কথাটা শুনলে চমকে উঠতে হয় বৈকি! তবে আমরা চমক সৃষ্টি করতে চাই না। কিছুটা খ্যাপামি আছে, বিশু পাগলই তো শুধু রক্ত করবীর খোঁজ রাখে। স্পর্ধা নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীর গতি, সে-পৃথিবীর সঙ্গে জীবজগতের সম্পর্ক, এ-সব নিয়ে প্রতিদিন সংবাদ পরিবেশন করা, কঠিন। কিন্তু পৃথিবীর গতির সঙ্গে মানুষের তাল মিলিয়ে চলার গোটা প্রক্রিয়াটাইতো দুঃসাহস। ‘বিজ্ঞানভাষ’ সেই দুঃসাহসের অংশীদার। তারই প্রেরণা থেকে শুরু হল দৈনিক বিজ্ঞানভাষ-এর পথ চলা।
ভাবনাটা পুরনোই। বাংলা ভাষার ছন্দ আর নান্দনিক অন্তরের সঙ্গে বিজ্ঞানের শক্তি, সৌন্দর্য আর স্পর্ধার সম্মিলন। স্বপ্ন দেখা- পাতা নড়া জল পড়ার মতো বিজ্ঞানের প্রতিটা শব্দ প্রতি অনুক্ষণে যেন পৌঁছে যায় বাংলা ভাষায় কথা বলা প্রত্যেকের কাছে। যেভাবে আমরা খেলার জগতের পান থেকে চুন খসার খবর নিয়ে মেতে উঠি, রাজনীতি বা বিনোদনের নেশায় ডুবে যাই, সেভাবে তো আমরা বিজ্ঞানের ধরা-অধরা জগতে পা ফেলতে চাই না। সে জগৎ আমাদের কাছে সুদূরের গ্রহ, ওটা যেন বিজ্ঞানী নামের অতিপ্রাকৃতিক, অধিভৌতিক অস্তিত্বের অধিকারীদের একমাত্র হকের জিনিস। আমা-জনতার আলোচনায় বিজ্ঞানের কল্পনা যেন বড় কঠিন, কর্কশ, দাঁতভাঙা। ‘অতসত বুঝিনা বাবু’ তেই তার পথচলা শেষ হয়। যদিওবা কেউ চেষ্টা করেন বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ব বা তথ্যকে সোজা-সাপটা ভাবে পৌঁছে দিতে- তখন আবার ভ্রুকুটি ছুটে আসে সনাতন ধর্মচারীদের থেকে। ‘জোলো’ হয়ে যাচ্ছে বলে অপাংতেয় মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বিজ্ঞান যে পৃথিবীর সতত বয়ে চলা সহজ, সরল অস্তিত্বের চর্চা- তা মেনে নিতে মন চায়না কিছুতেই। সংস্কৃতি আর অভ্যাস আমাদের বড় বালাই। দাঁতফাটা শব্দে শোভিত হয়ে টাই পড়া সাহেবরা যতক্ষণ মাথায় মুগুর মেরে বিজ্ঞানের কথা আমাদের বলেছেন ততক্ষণ মনে হয় না ব্যাপারটা জমলো। স্কুলে বিজ্ঞান পড়ার ব্যাপারটা তো এখনও পুরোপুরি ভূতের বাড়ীর প্রবেশাধিকার গোছের করে রাখা আছে। ফাটাফাটি নম্বর পেয়ে খোলসা মাথা ঠিক করার মানদণ্ডে যারা উত্তীর্ণ হতে পারেন- তারাই শুধু সাহস করে বিজ্ঞান পড়েন। ‘তোর মাথা নেই, বিজ্ঞান টানতে পারবিনা’- শুনতে শুনতেই অনেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওবাড়ীর দরজায় কড়া নাড়ার সাহস পাননা। এর পরের গপ্পোটা আরও পরিচিত। শুধু সোপান বেয়ে এগিয়ে চলা। কারো বা আছড়ে পড়া, মাথা ফাটা। ডিগ্রীর ঝনঝনানি আর অভিজাত্যের কার্পেটে পথ চলতে চলতে বিজ্ঞানের ঢেকুর তোলা চলতেই থাকে। হীরক রাজার সভার মতো অনেকটাই। রাজসভা-বিদ্যৎসভায় যখন আলোর রোশনাইতে ঝলকে ওঠে বিজ্ঞানের পরীকশায় পাওয়া নম্বর তখন সমাজ জুড়ে চলতে থাকে বুজরুকী, সংস্কার আর লীলা খেলার চর্চা। হবে নাই বা কেন? আমরা তো মানুষের জীবন ও বিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের কথা বলিইনি কখনও। বিজ্ঞান হয়ে আছে সমীহ আর সম্ভ্রমের বস্তু। বিজ্ঞান পড়ার অধিকারটাও ঠিক ওরকম পরিখা দিয়ে ঘেরা। মাথা যথেষ্ট ভালো না হলে সে নাকি বিজ্ঞান বুঝবে না। অতএব ও পথে তার যাতায়াতের ক্ষমতা নেই! ভালবাসা নয়, মেধার অদ্ভুত মাপকাঠিতে ভালো সাফল্য না আসলে বিজ্ঞান পড়া যাবে না। এটাই দস্তুর। উল্টোদিকে মেধার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে যারা বিজ্ঞানের রথে চেপে বসতে পারে, নিজেদের সর্বোত্তম ও সফলতম মানুষ ভাবার গর্বে তাদের পা আর মাটিতে নামতেই চায় না। বিশ্বাস পথ আটকায় যুক্তির, তর্কের, নতুন ভাবনার।
দেশ বিরাট, বিচিত্র তার লোক-সংগঠন, ভাষা, আচার-বিচার। এমন এক লোকসমষ্টির মধ্যে বিজ্ঞানের চর্চা করতে হলে “কুলীন” অহংকারটাকে বিসর্জন দিতে হবে। বিজ্ঞানকে নিত্যদিনের সঙ্গী করতে হবে, লোকের সঙ্গে লোকের কথায়-বার্তায় বিজ্ঞানকে নিয়ে আসতে হবে, তাতে লোকেরও সমৃদ্ধি, বিজ্ঞানেরও। ময়ূরাক্ষী, দামোদর, অজয়, গঙ্গা, তিস্তা, তুঙ্গভদ্রা ঘেরা এ বঙ্গে একাজের একমাত্র বাহন হতে পারে বাংলা।
মজার ব্যাপার হল- বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলা গ্রামে হয়না, শহরেও না। অথচ টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে বাংলার গাঁ-এর মাঠগুলোতেও এখন বছর জুড়ে ফুটবল সরিয়ে ক্রিকেট খেলা চলছে। দৃশ্যশ্রাব্য ও সমাজ মাধ্যমে ভাল করে ‘খাওয়াতে’ পারলে মানুষের ভাবনা ও ব্যবহারকে যে প্রভাবিত করা যায়- করোনা পরিস্থিতি সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল। যত ভয়, শঙ্কা, ভুল তথ্যের ঢেউ সামলে আমরা এখনও করোনাকে নিয়ে ঘর করছি এবং করোনাকে কেন্দ্র করে নানা খবরের চর্চা করছি তার অনেকটাই এই সূত্রগুলোতেই পাওয়া। আসলে ভয়ের খবর অসহায়ত্বের আবরণে ঢাকা পৃথিবীতে ছড়ায় বিদ্যুতের থেকেও তাড়াতাড়ি। অজানা, অচেনা, হানিকর বিষয়কে জানার জন্য আগ্রহের মাটি তৈরীই থাকে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে সেই আগ্রহের শিখাটাকে প্রজ্জ্বলিত রাখার, শুদ্ধ রাখার। দু’দণ্ড মানুষের পাশে বসে, তার কথা শুনে যদি পথ ঠিক করি, তাহলে পথ নিজেই এসে আমাদের সামনে হাজির হবে। বিজ্ঞান পড়ার আগ্রহ তৈরি করতে গেলে আগে দরকার বিজ্ঞান শোনা ও বিজ্ঞান বলা, বিজ্ঞান নিয়ে কথোপকথন। বিজ্ঞানভাষ যদি এটা করতে চায়। সে শুনতে চায়, এবং সেই শোনা থেকে পাওয়া পথ ধরে বিজ্ঞানের কথোপকথন চালিয়ে যেতে যায়। বিজ্ঞানের ভাষা, আমাদের মানতেই হবে, মুখের ভাষা থেকে আলাদা। কিন্তু, এটাও মানতে হিওবে যে, মুখের ভাষা থেকে রসদ না নিয়ে বিজ্ঞানের ভাষা তৈরি হয় না। বিজ্ঞানভাষ এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে বিজ্ঞানের ভাষাকে এমনভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে চায়, যাতে তথাকথিত সাধারণ মানুষের কাছে তার আসা-যাওয়াটা হয়ে ওঠে সহজ আত্মীয়তার মতো। প্রতিটা মানুষ ভাবতে শুরু করবে, বিজ্ঞান আমারও। ভূতপূজো বন্ধ হয়ে বিজ্ঞানের কেন্দ্র হবে গ্রামে, শহরের বহুতলে, পাড়ায়, বস্তিতে।
সব স্পর্ধা, সব ঐতিহ্য, ইতিহাসের শিক্ষা বুকে নিয়ে বিজ্ঞানভাষ দৈনিক হচ্ছে। সঙ্গে আছে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য। বিজ্ঞানের বিশ্বে লোকসমাজের পদার্পণ ঘটবে, বিজ্ঞান নিজেকে লোকবিশ্বে উপস্থিত করবে, এই আশাই বিজ্ঞানভাষ দৈনিকের দুঃসাহস। সম্বলও বটে।