বিজ্ঞানে বিশ্বাস, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বাস বনাম প্রশ্নের অভ্যেস

বিজ্ঞানে বিশ্বাস, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বাস বনাম প্রশ্নের অভ্যেস

Posted on ১৩ আগষ্ট, ২০১৯

“সোমপ্রকাশ। – স্বয়ং হার্বাট স্পেন্সার একথা বলেছেন। আপনি হার্বাট স্পেন্সারকে জানেন ত?

ভবদুলাল। – হ্যাঁ……হার্বাট, স্পেন্সার, হাঁচি, টিকটিকি, ভূত, প্রেত সব মানি।”

চলচিত্ত-চঞ্চরি (সুকুমার রায়)

আপনি তো বিজ্ঞান মানেন। নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তমনা হিসেবে দাবী করতে আপনি নিশ্চয়ই গৌরববোধ করেন? তাহলে, দৈনন্দিন ভাবনার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ তো আপনার একেবারে মজ্জাগত?

না না, প্লীজ অমন করে অপমানিত বোধ করবেন না। সত্যি বলতে কি, একটু জিজ্ঞেস করছিলাম এজন্যেই, কেননা, মুখে বিজ্ঞানমনস্ক বলে বড়াই করতে ভালোবাসলেও, আমাদের অধিকাংশের বিজ্ঞান মানার সাথে ভবদুলালবাবুর হার্বাট স্পেন্সার মানার বিশেষ ফারাক নেই।

অন্যভাবে বলতে হলে, বেশ গোঁড়া ধর্মাচারীর সাথে আমাদের অধিকাংশের বিজ্ঞান মানার মূলগত ফারাক কোথায়? আদৌ রয়েছে কি কোনো তফাৎ?

আরেকটু খোলসা করে বলি? গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী যদি গীতা-কোরাণ-বাইবেল-ইত্যাদিকেই ধ্রুবসত্য মনে করে চলেন, বা পাদ্রী-মোল্লা-ইমাম-গুরুর বাণীকে চূড়ান্তরূপে অনুসরণযোগ্য বলে মেনে নেন, আপনিও তো ঠিক তেমন করেই বিজ্ঞানী-গবেষকের কথাকেই বেদবাক্য বলে ধরে নেন। তাই না?

তাহলে, ওঁদের বিশ্বাস আর আপনার বিশ্বাসের ফারাক রইলো কোথায়? রইলো কি কিছু? আপনি বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, অতএব আধুনিকমনস্ক সচেতন নাগরিক, এমন করে কলার তোলার কোনো যুক্তি রয়েছে কি?

বিজ্ঞানমনস্কতা খুব ভালো ব্যাপার, কিন্তু অন্ধ বিজ্ঞানভক্তি? সেই দুইয়ের মধ্যে ফারাকই বা কী?

বিজ্ঞান কী, এই প্রশ্নের বিবিধ উত্তরের মধ্যে অন্যতম গ্রাহ্য উত্তরটি ছিলো কার্ল পপারের। তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞান হলো তা-ই যাকে ভুল প্রমাণ করা যায়। অর্থাৎ, অন্ধভাবে ভরসা নয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যই হল, চ্যালেঞ্জের মুখে তা নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে পারছে কিনা, এমনকি নতুন পরিস্থিতিতে নতুন যাচাইয়ের মুখেও তার গণনা যথার্থ থাকতে পারছে কিনা – নিরন্তর সেই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়া।

বিশদে বলতে গেলে, যেকোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতার মূলই হলো তাকে নিরন্তর চ্যালেঞ্জ করে যাওয়া, তাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্যে নতুন নতুন পরীক্ষার মধ্যে ফেলা। অর্থাৎ, নতুন পরীক্ষা বা নতুন প্রশ্ন বিজ্ঞানের স্বরূপগত ধারণার একেবার মজ্জাগত।

কথাটা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হলেও, বিজ্ঞানের অপরিহার্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়েও কি সমান সত্যি নয়? এখন, আপনি যদি বিজ্ঞানমনস্ক হন, তাহলে আপনিও প্রশ্ন করবেন, প্রশ্ন করতে থাকবেন, এইটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে, এই প্রশ্ন করার প্রবণতা খুব জরুরী। আর পাঁচটা বিষয়ের মতই, অন্ধবিশ্বাস দিয়ে কাজের কাজ হয় না – এমনকি সেই অন্ধভক্তি যদি বিজ্ঞান নিয়ে থাকে, তাহলেও।

না, এমন দাবী করছি না, উচ্চতম পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ব্যাপারে আপনি এতোটাই সড়গড় হবেন যে, সেই তত্ত্ব বিচার করে তা সঠিক না ভ্রান্ত আপনি নিজেই বুঝে নেবেন। আমার বক্তব্য, বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকটি নিয়ে। সেই বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে উত্তরের অন্বেষণের জন্যে তো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

বিজ্ঞান গবেষণা ঠিক কোন পথে চলছে, তার সুফল পৌঁছোচ্ছে কার ঘরে, সেই গবেষণার অর্থ যোগাচ্ছেন কারা, সেই গবেষণালব্ধ ফলাফলে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন কারা, আর্থিক দিকটা ছেড়ে যদি দিইও, বিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত কোন শ্রেনীস্বার্থ রক্ষা করছে বা কোন সমাজব্যবস্থাকে বজায় রাখছে অথবা কোন সমাজব্যবস্থার দিকে আপনার নজরকে টানছে – একটু চোখকান খোলা রাখলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া তেমন জটিল নয়।

(ঠিক যেমন করে, ধর্মবিশ্বাসী হয়েও ধর্মের জটিল দর্শন আপনার দুরূহ বোধ হতেই পারে। কিন্তু, তদসত্ত্বেও, ধর্মের বিভেদের ফল কী, ধর্মে মাতোয়ারা হয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর থেকে আপনার নজর সরে থাকছে, ধর্মবিশ্বাস গিলিয়ে কোন শ্রেণী-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, এই প্রশ্ন তো আপনি করতেই পারেন। পারেন না কি?)

একদিকে এই প্রশ্ন করার অভ্যেস আপনিও হারিয়ে ফেলে বিজ্ঞান বিষয়ে অন্ধ সমীহ রেখে চলেছেন – আরেকদিকে, বিজ্ঞানকে একটা নির্দিষ্ট পথে চালনা করে লাভের গুড় যাঁরা খেয়ে যাচ্ছেন, তাঁরাও আপনাদের প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকছেন, বলছেন, বিজ্ঞান বড় হাইফাই ব্যাপার, ও আপনার বিদ্যেয় কুলোবে না, বিশেষজ্ঞ না হলে কূলকিনারা পাবেন না। এর ফলে সমস্যাটা ঠিক কোথায় তৈরী হচ্ছে, সেই কথাটুকুও ভেবে দেখেছেন কি?

বড্ডো ভাসাভাসা হয়ে যাচ্ছে কথাগুলো? আরেকটু স্পেসিফিক হলে ভালো হয়?

আচ্ছা, বেশ, তাহলে একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। একেবারে আমাদের জীবনমরণের সাথে ওতপ্রোত চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদাহরণ দিই?

সবার মতো আপনিও, নিশ্চয়ই, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতিতে ভরসা রাখেন? আপনিও নিশ্চয়ই জানেন, এবং মানেন, যে, চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। অতীতের অনেক দুরারোগ্য অসুখ আজ নিরাময়যোগ্য। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আজ নেই, যে অসুখগুলোর চিকিৎসা আজ নেই, আপনিও নিশ্চয়ই আশা রাখেন যে, শিগগিরই, মিলে যাবে বাকি দু-আনা। এও নিশ্চয়ই মেনে নিয়েছেন, যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মত জটিল বিষয়ের উচ্চতর গবেষণা যেহেতু আপনার ধারণার বাইরে, সেহেতু এত বড় বড় কোম্পানির ল্যাবে এত বড় বড় চিকিৎসক-গবেষক যা করছেন, নিশ্চয়ই বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়-ই করছেন।

বাঃ, খুব ভালো। আপনি চূড়ান্ত আশাবাদী বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষ তাহলে।

কিন্তু, অভ্যেসটা বদলে, একটু প্রশ্ন করুন। ভাবুন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই উন্নতির জন্যে, গবেষণার কাজটা করছেন কারা? তাঁরা ঠিক কাদের স্বার্থরক্ষার্থে গবেষণা করছেন বা তাঁদের গবেষণার ফলাফলজনিত লাভের গুড় খাচ্ছেন কারা? না, প্লীজ, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে ব্যাঁকা হাসিটা ডাক্তারদের দিকে ফেরাবেন না। আমি জানি, আশেপাশের জানাচেনা ডাক্তারদের উপর আপনার ভরসা নেই – কিন্তু, মুখ না দেখা সেইসব সুদূরের উচ্চমার্গের গবেষকেরা, যাকে বলে, ক্যান ডু নো রং। তবুও, একটু শুধু ভাবুন, এই গবেষণার জন্যে অর্থ জোগাচ্ছেন কারা? বাংলা করে বললে, ফান্ডিং-এর উৎস কোথায়?

সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞান কোনো শাশ্বত সত্যের সন্ধানে দিনরাত এক করে ফেলেছে, এমনটা ভাবার মধ্যে কিঞ্চিৎ আত্মপ্রসাদ থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবের ছায়া এই ভাবনায় নেই।

হ্যাঁ, অবশ্যই, বিজ্ঞান কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। প্রশ্ন করা, নিরন্তর প্রশ্ন করে যাওয়া, আর তার উত্তর খোঁজা, আগেই বলেছি, এই-ই বিজ্ঞানের ধর্ম। কিন্তু, এই পুঁজিবাদী মুক্ত অর্থনীতির বিশ্বে, বিজ্ঞান-গবেষণার অর্থের সংস্থান কোন সূত্রে, এও এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, অজস্র সম্ভাব্য প্রশ্নের মধ্যে, ঠিক কোন প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান খুঁজবে এবং অজস্র সম্ভাব্য উত্তরমালার মধ্যে, ঠিক কোন উত্তরটি গৃহীত হবে, তার মূলে কিন্তু জড়িয়ে রয়েছে স্পনসরের নাম।

একটা সময় ছিলো, যখন এই চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার মূল কাজটা হতো বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, মুখ্যত পশ্চিমী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই। খরচ জোগাতেন সরকার। আর, গবেষণার সুফল পেতেন সাধারণ নাগরিক। কিন্তু, ধীরে ধীরে সময় বদলাতে থাকলো। শুরুটা মার্কিন দেশ থেকে। তারপর সেই সিস্টেম গৃহীত হলো সর্বত্র।

তিন কি চার দশক আগে সরকার বলতে থাকলেন, যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে হবে। এবং গবেষণার খরচ জোটানো তো বটেই, সরকার চাইলেন, গবেষণা হোক লাভজনক, যাতে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে চালানো যায় সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়টাই। শুরুটা হলো পেটেন্ট বিক্রি দিয়ে। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ফল কিনে নিতে থাকলো বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি। স্বাভাবিকভাবেই, যে ওষুধের পেটেন্ট বিক্রির সুযোগ বেশী, গবেষণা চলতে থাকলো সেই পথেই। আর এখন তো সর্বার্থেই, বসন্ত এসে গেছে। গবেষণার সব পর্যায়ে, বিষয় নির্বাচন থেকে গতিপথ, পুরোটাই বহুজাতিক ওষুধকোম্পানির মতামত শিরোধার্য। এমনকি, চিকিৎসাগবেষকদের একটা বড়ো অংশ ওষুধকোম্পানির সাথে সরাসরি যুক্ত। গোপনে নয়, একেবারে খাতায় কলমে।

ফলও মিলছে হাতেগরম।

যেমন ধরুন, প্রতি বছর, এই বর্ষার শেষে ম্যালেরিয়ায় মারা যান বেশ কয়েকশো মানুষ। আক্রান্ত হন তার চাইতে বেশ কয়েকগুণ। বিশ্বের অনেক দেশেই, বছরপিছু ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক হাজার। সারা পৃথিবীর হিসেব ধরলে, প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা যান এই ম্যালেরিয়ায়। আক্রান্ত হন কুড়ি কোটিরও বেশী মানুষ। হ্যাঁ, প্রতি বছর। কখনো প্রশ্ন জেগেছে মনে, যে, বিগত কয়েক দশকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার নতুন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে কি?

আচ্ছা, যে চিকিৎসাবিজ্ঞান ফিবছর কয়েক ডজন নতুন ওষুধ বাজারে এনে ফেলতে পারে, হাইপ শুনলে বোধ হয় যার নাকি সবগুলোই বৈপ্লবিক এবং যুগান্তকারী, সেই বিজ্ঞানের এলেমে কুলোয় না ম্যালেরিয়ার নতুন ওষুধ আবিষ্কারের?

ম্যালেরিয়ার কথা বাদ দিন। যক্ষ্মাতে আসুন। আপনি তো সচেতন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কাজেই, জানেন নিশ্চয়ই, এই শতাব্দীতে টিবি এবার বড়সড় সমস্যা হয়ে ফিরে আসছে। আর, এইবার তেমন তেমন টিবি ফিরে আসছে, যেগুলো টিবির প্রচলিত ওষুধগুলোতে সাড়া দেয় না, যার চিকিৎসা সত্যিই জটিল। বিশ্বজুড়ে, বছরে পনেরো লক্ষেরও বেশী মানুষ মারা যান এই মারণরোগে। আক্রান্তের সংখ্যা তার কয়েকগুণ। তাহলে কি টিউবারকিউলোসিসের নিত্যনতুন ওষুধ বাজারে আসছে প্রতিমাসে?

নাঃ, আসছে না। গত দুই দশকে টিবি-র চিকিৎসার নতুন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে এমন নয়। টুকটাক পরীক্ষানিরীক্ষায় জানা গিয়েছে যে, প্রচলিত কিছু অ্যান্টিবায়োটিক টিবি-তেও কাজ করে। ব্যাস, এইটুকুই। নতুন রকমের টিবি-র মোকাবিলায় সম্বল ওই পুরোনো অ্যান্টিবায়োটিকগুলিই।

আরে, নতুন ওষুধ আসবে কোত্থেকে? ম্যালেরিয়া বা যক্ষ্মার ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায় কর্পোরেট বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির উৎসাহ নেই। কাজেই গবেষণা কই, যে ওষুধ আসবে?!

তাহলে? মারণ রোগের চিকিৎসার জন্যে ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে না?

না না, হচ্ছে তো। রোজই হচ্ছে। প্রায় প্রতি মাসেই আসছে ক্যানসার বা ডায়াবেটিসের নতুন ওষুধ। এমনকি, প্রতি বছরেই আসছে এইডসের চিকিৎসার নতুন ওষুধও।

শুধু একটু ফারাক রয়েছে।

এই ওষুধগুলোর কোনোটিতেও ক্যানসার-ডায়াবেটিস-এইডস সেরে যায় না। অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়, এইটুকুই। তাহলে? বুঝলেন খেলাটা?

এতেও না বুঝলে তো মুশকিল। একেবারে পুরোটা খুলে না বললে তো আপনার কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশানো অসম্ভব!! যাক, সেই কঠিন কাজটা আমাকে করতে হচ্ছে না। জগদ্বিখ্যাত অর্থনৈতিক সংস্থা গোল্ডম্যান-স্যাক্স ধোঁয়াশা না রেখে, একেবারে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, যে ওষুধে অসুখ সেরে যায়, এমন ওষুধের জন্যে গবেষণার মধ্যে, আর যা-ই হোক, ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা নেই। এমন রিসার্চ প্রোজেক্ট ফিনান্সিয়ালি ননভায়েবল। অতএব, সমঝদারি সির্ফ এ্যায়সি প্রোজেক্টমে হ্যায়, যেখানে অসুখ কন্ট্রোলে থাকে, আর চিকিৎসা চলতে থাকে, চলতেই থাকে।

আশা করি, এরপরে আপনি আশ্চর্য হবেন না শুনে যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই গৌরবময় জয়যাত্রার বাজারেও, গত দশ পনেরো কি পঁচিশ বছরে, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রায় কোনোই নতুন ক্লাস (অর্থাৎ যে অ্যান্টিবায়োটিক সম্পূর্ণ নতুন পথে জীবাণুদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে) আবিষ্কৃত হয়নি, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক বলতে পুরোনো ক্লাসেরই একটু রদবদল মাত্র। না, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণাতেও তেমন লাভ নেই।

একটু খেয়াল করুন। সারা বিশ্ব জুড়েই, সংক্রামক ব্যধিগুলো নতুন চেহারা নিয়ে ফিরে আসছে। কিন্তু, সেই নিয়ে আমাদের তথাকথিত বিজ্ঞানের মাথাব্যথা কতোটুকু?

ছেড়ে দিন না হয় ওইসব ফালতু ওল্ড-ফ্যাশনড অসুখগুলোর কথা। আধুনিক চিকিৎসা গবেষণার ব্লু-আইড বেবির কথায় আসুন। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। আমি ক্যানসারের কথা বলতে চাইছি।

ক্যানসার গবেষণার বাজেটের অধিকাংশটাই খরচা হয় ক্যানসার চিকিৎসাসংক্রান্ত গবেষণায়। সামান্য অংশই পড়ে থাকে ক্যানসার প্রতিরোধ নিয়ে ভাবার জন্যে। কেননা, ওই অর্থনীতি-বাণিজ্য-ইত্যাদি। আরে বাবা, অসুখটা না-ই হতে পারলে, চিকিৎসা-ই বা কোথায়, আর ব্যবসার সুযোগই বা কোথায়!!

আচ্ছা, কখনও মনে প্রশ্ন জেগেছে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় জেনেটিক্স বা জিন-এর এই সর্বব্যাপী প্রভাব এলো কোত্থেকে? বা, এই জিন-সর্বস্বতার অভিঘাতই বা কী?

জেনেটিক্স চর্চায় আমরা এতোটাই এগিয়ে গেছি, অথবা বিজ্ঞানে জিন-বাদীদের (কথাটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম) দাপট এতোখানিই বেড়ে গিয়েছে, যে, মানুষকে প্রায় শুধুমাত্র একগুচ্ছ জিনের সমষ্টি ভাবতেও অসুবিধে হচ্ছে না আর। চিকিৎসা চূড়ান্ত পর্যায়ে পার্সোনালাইজ করার নামে, মানুষকে অপমানব হিসেবে ভেবে ফেলতেও অসুবিধে হচ্ছে না। যা বলা হচ্ছে, তার মানেটা প্রায় দাঁড়ায়, আপনার শরীর-স্বাস্থ্য-স্বভাবপ্রকৃতি-অসুখবিসুখ – কোনোকিছু নিয়েই আলাদা করে ভাববেন না – জাস্ট জিনটুকু জানলেই কেল্লা ফতে – ভূত-ভবিষ্যৎ হাতের মুঠোয়।

এই চিন্তাধারায় উৎসাহী চিকিৎসক এরিক টোপোল যেমন বলেন, “ This is a new era of medicine, in which each person can be near fully defined at the individual level, instead of how we practice medicine at a population level, with mass screening policies for such conditions as breast or prostate cancer and use of the same medication and dosage for a diagnosis rather than a patient.”

শুনতে ভালো লাগে, তাই না?

টোপোল সাহেবের উচ্ছ্বাসের কারণ অবশ্য স্পষ্ট। “It is because for the first time in history we can digitize humans.”

Digitise humans??

কেন? বই-পত্র-খবরের কাগজ, সবই তো ডিজিটাইজ করা যায়, তাহলে মানুষকেই বা যাবে না কেন? অন্তত, মানুষকে যদি যান্ত্রিকভাবে কিছু তথ্যের সমাহার হিসেবে ধরে নেওয়া যায়?

এতে সুবিধে ঠিক কী? কেন?

“We can now perform whole genome sequencing of a fetus to determine what conditions should be watched for postnatally. At the other end of the continuum of life, we can do DNA sequencing to supplant a traditional physical autopsy, to determine the cause of death.”

অর্থাৎ, যেমন বললাম আগেই, স্রেফ জেনেটিক তথ্য জানা থাকলেই আপনি নাকি একজন মানুষের অসুখবিসুখ ভূতভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।

এককথায়, “We can dissect, decode and define individual granularity at the molecular level, from womb to tomb.”

আমি বুঝতে পারছি, এইবারে আপনি ধৈর্য্য হারাচ্ছেন। বিরক্ত হচ্ছেন। ভাবছেন, এই নিয়ে এতো বাজে বকার কী হয়েছে!! বিজ্ঞানের চমকপ্রদ অগ্রগতিতে গা চুলকোনোর কারণ কী!! আমাদের তো আরো উৎসাহের সাথে দুহাত বাড়িয়ে এই অগ্রগতিকে আহবান জানানো উচিৎ, তাই না?

না, শুধু ঘোর বিজ্ঞানবাদী হয়ে প্রশ্নহীন আনুগত্য দিয়ে পুরোটা বোঝা যাবে না৷ একটু ভাবুন।

ধরুন, এমনকি বংশগতভাবে প্রাপ্ত ক্যানসারের ক্ষেত্রেও পরিবেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। আর, বাকি অধিকাংশ ক্যানসারের ক্ষেত্রে পরিবেশের ভূমিকাই প্রধান। আজ আমাদের চারপাশে ক্যানসারের যে প্রাদুর্ভাব, তার পিছনে লাগামছাড়া দূষণ, খাবারে রাসায়নিক, ভেজাল ইত্যাদির ভূমিকা তো কম কিছু নয়। খেয়াল করুন, সরকার কিন্তু এই সব বিষয়ে নিস্পৃহ। আপনার ক্যানসার হলে দায়ী আপনার জিন, এবং আপনার জীবনযাপন, এমনটাই গিলেছেন আপনি, মানে তেমনভাবেই ভাবতে শেখানো হয়েছে আপনাকে (এমনকি, এক বড়ো অংশের ডাক্তারকেও)। সরকারও নিরাপদ, কেননা দূষণ-রাসায়নিক ইত্যাদিতে হাত দিতে গেলে কর্পোরেট বহুজাতিকের লাভের গুড়ে চোনা পড়ে, সে ভারী ঝুঁকির ব্যাপার। আপনার বিজ্ঞানের উপর প্রশ্নহীন আনুগত্যের ঠেলায়, আপনি কিন্তু সরকারকে, বা প্রচলিত ব্যবস্থা বা চিন্তাপদ্ধতিকেই চ্যালেঞ্জ করতে ভুলে যাচ্ছেন।

চিকিৎসা গবেষণার যা বাজেট, তার অনেকটাই যাচ্ছে জিনথেরাপি-ইমিউনোথেরাপির পেছনে। গতবছর তো চিকিৎসা-রসায়ন, একেবারে জোড়া নোবেল এই নিয়েই। দেশে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মান, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারের একটি এইবার এসেছে এই সংক্রান্ত গবেষণায়।

তা, কর্পোরেট কোম্পানী গবেষণায় টাকা ঢালবেন, আর তার বাজার তৈরী করতে সচেষ্ট হবেন না??!! দুর্মূল্য এই চিকিৎসার বাজার তৈরী করতে, আপনার চিন্তাপদ্ধতির নিয়ন্ত্রণ জরুরী। আর, তাছাড়া আগে যেমন বললাম, জিন-এই সব অসুখের রহস্য লুকিয়ে, এইটা বোঝানো গেলে, কর্পোরেট বহুজাতিকের বাকি দূষণ ছড়ানোর ব্যবসার দিকেও আপনার নজর যায় না।

এই পথে চলেই, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাথে যুক্ত দুই গবেষক, হোসে লুই করদেইরো এবং ডেভিড উড, মাসছয়েক আগে স্প্যানিশ ভাষায় একখানা বই লিখে ফেলেছেন। বাংলায় অনুবাদ করলে নাম দাঁড়ায়, মৃত্যুর মৃত্যু।

উপপাদ্যটি সরল। আমাদের ব্যধি-জরা-মৃত্যুর রহস্য লুকিয়ে আমাদের জিনের ভিতরে। সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতির ব্যবহারে ওইটুকু দোষত্রুটি সামলে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। বয়স বেড়ে বুড়ো হওয়া স্রেফ একটা অসুখমাত্র, যার নিরাময় সম্ভব। ইন ফ্যাক্ট, বার্ধক্যকে একটা অপরিচ্ছন্নতা হিসেবেই দেখা উচিৎ, যার জন্যে অসুখবিসুখ হয়। সেইটা দূর করা সম্ভব। সব ঠিকঠাক চললে, বেশী দূর নয় সেই সুদিনের, এই ২০৪৫ সাল নাগাদই মানুষের মৃত্যু ব্যাপারটাই ধরাধাম থেকে দূর করা যাবে।

অর্থাৎ, জিনের উপর আস্থা রাখুন। নতুন চিকিৎসাপদ্ধতির উপর আস্থা রাখুন। অসুখের মূল আপনার মধ্যেই লুকিয়ে। একটু ঠিকঠাক করে নিলেই, ব্যাস, আপনার সামনে অমরত্বের হাতছানি।

না, সমস্যাটা এইখানেই থেমে নেই। শিকড় আরো অনেক গভীরে।

সমাজের মাত্র তিন কি চার শতাংশ মানুষ মিলে বাকি পঁচানব্বই শতাংশকে দাবিয়ে রাখতে পারার রহস্য কিন্তু অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে লুকিয়ে। আপনি যদি একবার গিলিয়ে দিতে পারেন যে, এ জন্মের দুঃখকষ্ট, দুর্গতি বা শোষণের কারণ পূর্বজন্মের অপরাধ বা পাপ, এই লাঞ্ছনা ভবিতব্য মাত্র, তাহলে তো নির্যাতিত মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থাটাকে চ্যালেঞ্জ করবে না। তাই না?

একইভাবে, আপনি যদি বিশ্বাস করে নিতে পারেন যে, সব অসুখবিসুখের কারণ সেই আপনার জন্মসূত্রে পাওয়া জিনের মধ্যে লুকিয়ে, তাহলে খুব সহজেই আপনার নজর এড়িয়ে যেতে পারে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, খেতে না পাওয়া মা, সিলিকোসিসে ভোগা শ্রমিক বা কারখানার দূষণে বিস্তীর্ণ এলাকায় মৃত্যমিছিল, যেমন কিনা ঘটলো তুতিকোরিনে।

তাহলে, প্রচলিত ব্যবস্থাটাকে প্রশ্নহীন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে প্রাচীন কালের ধর্মভীরুতার সাথে আপনার বিজ্ঞানমনস্কতার ফারাক কোথায়? (আর এর সাথে চমৎকার অকুন্ঠ ব্যবসার দিকটা তো রয়েছেই)

সাযুজ্যটা কি খুব জোর করে টেনে আনা মনে হচ্ছে?

একটা ছোটো উদাহরণ দিলাম মাত্র। এমন উদাহরণ চারপাশে অজস্র।

এর পাশাপাশিই, বিজ্ঞান দিয়ে কি জীবনের সবটুকুনিই ব্যাখ্যা করা সম্ভব? সেই ব্যাখ্যা প্রশ্নহীন মেনে নেওয়াও কি বিজ্ঞানমনস্কতা? সুস্থতা-ভালো থাকার সবটুকুই কি চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতায়?

এই প্রসঙ্গে নর্টিন হ্যাডলার যেমন বলেন, “Health is not a pure scientific construct; the components of health that can be quantified and studied systematically barely scratch the surface of what most of us mean by good health. Science is no match for individual perceptions of well-being, for the temporal component of well-being, or for the vagaries of the social construction of well-being.” কথাগুলো বারকয়েক পড়ে দেখুন। একটু ভাবুন। আপনার সুস্থ থাকা বা না থাকার ঠিক কতোখানি বা কতোটুকু বিজ্ঞান?

“Health in general, and good health in particular, does not lend itself to easy understanding because it has many components and reflects so much that is our humanity. In this regard, it is similar to other hard-to-define concepts, such as ‘love’ and ‘job satisfaction’.”

সেই বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যের ধারণাকে একটি নির্দিষ্ট পথে বাঁধতে চাওয়ার মধ্যে, ঠিক কোন ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে?

আপনি বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞান গবেষকও নন। কিন্তু, বিজ্ঞান কোন পথে এগোবে, কোন প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে, ব্যক্তিজীবন বা সমাজজীবনের ঠিক কতোখানি পরিসর বিজ্ঞানকে ছাড়া যেতে পারে, সেই নিয়ে সাধারণ নাগরিকের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী।

ধর্মের মতোই, বিজ্ঞানও, শাসকের হাতে বড়ো অস্ত্র। যদি না আপনি ঘুম থেকে জাগেন।

সঠিক ব্যবহার বা প্রয়োগে বিজ্ঞানের সদর্থক ভূমিকা নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু, এইটুকু সচেতনতা জরুরী, যাতে বিজ্ঞানের নাম করে কোনো কুটিল শ্রেণীস্বার্থ আমাদের শরীর-মনকে উপনিবেশ করে ব্যবসার বেসাতি না সাজাতে পারে।

তা যদি না পারেন, দোষটা কার? বিজ্ঞানের?

নাকি, আপনার প্রশ্নহীন মেনে নেওয়ার?