বিশ্ববীণারবে। পঞ্চম পর্ব

বিশ্ববীণারবে। পঞ্চম পর্ব

অর্পন নস্কর
Posted on ৩১ অক্টোবর, ২০২১

সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর গতি

দুপুরবেলা উত্তর গোলার্ধের আকাশে সূর্য থাকে কিছুটা দক্ষিণ দিকে, আর দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে সূর্যকে দেখা যায় কিছুটা উত্তর দিকে। এখন আমরা যদি কোনো একদিন দিনের বেলা (বিকেলের দিকে হলে ভালো হয়, তখন সূর্যের উজ্জ্বলতা কিছু কম থাকে) ক্যামেরা তাক করে সূর্যের একটা ছবি তুলি, কাজটা মোটেই কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু এইবার করতে হবে আসল কাজ। প্রত্যেকদিন ঠিক ওইসময় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তুলতে হবে সূর্যের ছবি। আর সারা বছর ধরে যদি এই ছবি তোলার ব্যাপারটা চালু রাখা যায়, আর বছর শেষে সবকটা ছবিকে মেলানো যায়, তাহলে দেখা যাবে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। দেখা যাবে, আকাশের বুকে সূর্যের অবস্থান মোটেই স্থির নয়, সে প্রত্যেকদিন বদলেছে খুব সামান্য করে। আর গোটা একটা বছরে তার অবস্থানে এই যে বদল, সেটা দেখতে হবে অনেকটা এইরকম—

ছবি। আকাশের বুকে বছরভর সূর্যের অবস্থানে বদল।

 

এই যে দুটো লুপে একটা পাক ঘুরে আসা, এই ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘analemma’। আর এখানে আশা করি এটা বোঝা যাচ্ছে যে একটা লুপের চেয়ে অন্য লুপটা কিছু বড়।

এই ব্যাপারটাকে এখন ব্যাখ্যা করা যাক। এর প্রথম কারণ, পৃথিবী যখন সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তার সেই ঘূর্ণন অক্ষ একেবারে লম্ব না, কিছুটা বেঁকে থাকে। এখন পৃথিবীর বার্ষিক গতির ঘূর্ণন তলের সঙ্গে তার ঘূর্ণন অক্ষের এই যে কিছুটা কোণ করে থাকা (যে কোণের মান ২৩.৫ ডিগ্রি), এই জন্যই পৃথিবীর যে গোলার্ধ যখন সূর্যের কাছে আসে, তখন সেই গোলার্ধ থেকে দেখলে সূর্যকে কিছুটা ওপরের দিকে আছে বলে মনে হবে।

তাছাড়া আমরা এটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছি যে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বছরের বিভিন্ন সময়ে দিনের দৈর্ঘ্য কম-বেশি হয়, আর ঋতু-পরিবর্তন ঘটে। শীতকালে দিন ছোট রাত বড়, গ্রীষ্মে উলটোটা। তাছাড়া সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়টাও বছরের বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা হয় এই কারণে, আর দুপুরবেলা ঠিক কটার সময় সূর্য থাকবে সবচেয়ে উঁচু অবস্থানে (ঠিক মাথার ওপরে থাকে না প্রায় কখনোই), সেটাও বছরের বিভিন্ন সময় বদলায়। আর এই ব্যাপারগুলো ঘটে এই কারণে যে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথ গোলাকার নয়, তা উপবৃত্তাকার। আগে কিন্তু মনে করা হত যে পৃথিবী যে কক্ষপথ বরাবর সূর্যের চারদিকে ঘোরে, সেটা বৃত্তাকার। উপবৃত্তাকার পথের এই ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন যিনি তাঁর নাম যোহানেস কেপলার। এঁর জীবন আর কাজের কথা আমরা পরে কিছুটা বিস্তারিত আকারেই বলব। এই উপবৃত্তাকার পথটা দেখতে এইরকম—

 

ছবি। সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে, এইরকম পথেই বেশিরভাগ গ্রহরাই ঘোরে

 

বৃত্তের যেমন একটা কেন্দ্র থাকে, উপবৃত্তের তেমন থাকে দুটি কেন্দ্র, দু-দিকে— এদের বলে ‘ফোকাস পয়েন্ট’, বাংলায় নাভিবিন্দু। সূর্য থাকে এইরকম একটা ফোকাসে। ছবি দেখে বোঝাই যাচ্ছে সূর্যের থেকে পৃথিবীর দুরত্ব সারাবছর একই থাকে না। যখন এই দূরত্ব কম হয় (১৪ কোটি ৭০ লক্ষ কিলোমিটার) তখন বলি ‘অনুসূর অবস্থান’ (perihelion), আর যখন বেশি হয় (১৫ কোটি ২০ লক্ষ কিলোমিটার) সেটা ‘অপসূর অবস্থান’ (aphelion)।

উপবৃত্তাকার পথে ঘোরবার ক্ষেত্রে আরও একটা ব্যাপার ঘটে, সেটাও কেপলার সাহেব বলেছিলেন, তা হল এই রকম পথে ঘোরবার সময় কোনো গ্রহের বেগ সবসময় একই থাকে না। যখন গ্রহটি সূর্যের কাছে আসে, তখন বেগ কমে যায়, আর দূরে গেলে বেগ যায় বেড়ে।

পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষ উপবৃত্তাকার পথে ঘোরবার যে তল, সেই তলের সঙ্গে পুরোপুরি লম্বভাবে না থাকবার জন্য সূর্যের আলো সব সময় পৃথিবীর মাঝ বরাবর লম্বভাবে পড়েনা, এটা একটু আগেই বলেছি আমরা। আর এই কারণেই পৃথিবীর ওপর আর নীচের দুই গোলার্ধের মধ্যে যেটি যখন সূর্যের কাছে আসে সেই গোলার্ধে তখন গরমকাল হয়, অন্যটিতে তখন শীতকাল। তবে পৃথিবীর ওপরে ও নিচের দুই মেরু অঞ্চল যে সারা বছরই ঠাণ্ডা, তার কারণও সবারই জানা।

(ক্রমশ)