বীজবাহক প্রাণীর বিলুপ্তি ও বন বিপর্যয়

বীজবাহক প্রাণীর বিলুপ্তি ও বন বিপর্যয়

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৫ আগষ্ট, ২০২৫

দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল, জলবায়ু পরিবর্তনই বন্যপ্রাণীর বিপন্নতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT)-র একটি গবেষণা দেখিয়েছে- বনজ প্রাণীর বিলুপ্তি কিভাবে নিজেই জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বীজবাহক প্রাণীর অনুপস্থিতিতে ক্রান্তীয় বনভূমি তাদের স্বাভাবিক কার্বন পুনরুদ্ধার ক্ষমতার প্রায় ৫৭% হারাতে পারে। হেক্টর প্রতি গড়ে বছরে ১.৮ মেট্রিক টন কার্বন কম ধরে রাখতে পারবে। ক্রান্তীয় বনভূমি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভূভাগ-ভিত্তিক কার্বন আধার। এগুলি বিশ্ব জুড়ে বার্ষিক মানবসৃষ্ট কার্বন নির্গমনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শোষণ করে। এই বনভূমির ৭৫ শতাংশ গাছের প্রজনন প্রক্রিয়া নির্ভর করে ফলভুক বা পরিক্রমণকারী প্রাণীর উপর। ফল খাওয়ার পর বীজ অন্যত্র নিয়ে গিয়ে তারা ত্যাগ করে। গাছের বিস্তার ও বনের পুনর্গঠনে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণী সংখ্যা হ্রাস পেলে, বীজের বিস্তার সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে অঙ্কুরোদ্গমের হার কমে। বনভূমির প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম ধীরগতিতে হয় কিংবা থেমে যায়। ফলত, ঐ বনে তরুণ গাছের সংখ্যা কমে এবং দীর্ঘমেয়াদে কার্বন শোষণক্ষমতা হ্রাস পায়। গবেষক ইভান ফ্রিকি এবং তাঁর সহ-গবেষকরা ১৭,০০০টির বেশি ক্রান্তীয় বনভূমি এলাকা থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বন্যপ্রাণীর ঘনত্ব, তাদের চলাচলের গতিপ্রকৃতি, বীজ বিস্তার কার্যকারিতা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় কার্বন মজুদের মাত্রা ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের তথ্য একত্র করেছেন। গবেষক দল একটি ‘বীজ বিস্তারে ব্যাঘাত সূচক’ তৈরি করেছেন। এটি এমন একটি বৈজ্ঞানিক পরিমাপক যার সাহায্যে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বীজ ছড়ানোর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় কতটা বাধা বা ব্যাঘাত ঘটেছে তা মাপা যাবে। বিশেষ করে ফলভুক বা বীজবাহক প্রাণীর সংখ্যা-হ্রাসের কারণে। সাথে বনাঞ্চলে প্রাণীঘটিত কার্বন শোষণের সম্পর্কও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তাঁদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, যেসব এলাকায় মানুষের ক্রিয়াকলাপ বেশি, যেমন নগরায়ন, বনভূমি খনন, শিকার বা বন্যপ্রাণী বাণিজ্য, সেখানে প্রাণীরা কম দূরত্বে চলাফেরা করে, ফলে বীজ-বিস্তারও সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে বনভূমির পুনরুজ্জীবন ক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে নেমে আসে। গবেষক সিজার তেরের মন্তব্য, “প্রাকৃতিকভাবে গাছ জন্মানোর প্রক্রিয়া কার্যত বিনামূল্যে হয়। তাতে জীববৈচিত্র্যও বেশি থাকে। কিন্তু গাছ লাগানোর প্রকল্পে তা থাকে না এবং তা ব্যয়বহুল।”

এই প্রেক্ষাপটে কিছু সুপারিশ উঠে এসেছে।
১. বন্যপ্রাণীর চলনপথ নির্মাণ ও সংরক্ষণ,
২. বনাঞ্চল সংলগ্ন প্রাকৃতিক আবাস পুনরুদ্ধার,
৩. প্রজাতিকে পুনরায় বনে ফেরানো,
৪.বীজবাহক প্রাণীকে আকর্ষণ করে এমন গাছের প্রাধান্য,
৫. বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। এ গবেষণা জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে সম্পর্ককে পরস্পরনির্ভর এবং সমান্তরাল সংকট হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আগে ধারণা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনই জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় ঘটায়। এই গবেষণা দেখিয়েছে, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ই জলবায়ু সংকটকে তীব্রতর করতে পারে — বিশেষ করে উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে। ফ্রিকির কথায়, “এই সম্পর্কগুলি নষ্ট হয়ে গেলে শুধু প্রজাতি নয় সমগ্র বন, এমনকি গোটা বিশ্বের কার্বন চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” সুতরাং, আগামী দিনের জলবায়ু নীতিমালায় শুধুমাত্র গাছ লাগানো নয়, বীজবাহক প্রাণীর সংরক্ষণ এবং পুনঃপ্রবর্তনকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সূত্র : Seed dispersal disruption limits tropical forest regrowth by Evan C Fricke, et.al ; Proceedings of National Academy of Science(25June, 2025)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten + seventeen =